মেধার কম বেশি বনাম পেশার পেশি
২৩ এপ্রিল ২০২১এই উত্তেজিত চরিত্রের জন্যই বোধহয় বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে বাসের মধ্যে লেখা থাকে, ‘ব্যবহারে বংশের পরিচয়’৷ এই উত্তেজনা সবখানে এখন বেড়েছে, বাড়ছে৷ ভাইরাল হওয়ার অবারিত সুযোগে উত্তেজিত ব্যবহারের বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা এখন রবীন্দ্র যুগের চেয়ে অনেক ধারালো৷ সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় ধারণ করা এমনই একটি উত্তেজিত আচরণের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা গেছে কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এক চিকিৎসকের উত্তপ্ত বাকবিতণ্ডা৷ পেশাজীবীদের উত্তেজিত ব্যবহারের এই ভিডিও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবীদের নৈতিকতা এবং পরিশীলিত আচরণের বাধ্যবাধকতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের অযাচিত ক্ষমতা প্রদর্শন যে নিয়ত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে সেই চিত্রও এই ঘটনায় ফুটে উঠেছে৷
ঘটনার ধারাবাহিকতায় এটি স্পষ্ট যে, পেশাগত অহমিকা প্রকাশ করতে গিয়ে পেশাজীবীদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিক প্রকাশ ও আত্মপরিচয় সংকটের প্রবণতা দৃশ্যমান৷ আত্মপরিচয় এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি কিংবা সমষ্টির কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য যেমন—নৃতাত্ত্বিক, জাতিগত, ধর্মীয় বা পেশাগত চর্চার মাধ্যেম নির্দিষ্ট পরিচয় নির্ধারিত হয়৷ এখানে ব্যক্তির সত্তাকে একটি সামগ্রিক পরিচয় দিয়ে তুলে ধরা হয়৷ সমস্যা হলো, এই সামগ্রিক পরিচয়ের সত্তা যখন অহংবোধে পরিণত হয় তখন সমসাময়িক অন্য পরিচয়গুলোকে তাচ্ছিল্য করা হয়৷ এক জাতি অন্য জাতির মানুষকে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মাবলম্বীকে কিংবা এক পেশাজীবী গোষ্ঠী অন্য পেশাজীবীদের হীন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করে৷ যেমনটা আমরা ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে দেখেছি৷ অন্যের চেয়ে নিজেকে ঢের সেরা হিসেবে উপস্থাপনের এই প্রতিযোগিতা ক্রমেই একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা পেশার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করে যে, ‘আপনার’ স্বতন্ত্রতার চেয়ে ‘আমার’ বিশেষত্ব অনেক উঁচুদরের৷
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে চোখ দিলে বুঝা যাবে, এই ধরনের ঘটনাবলী বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা বা ইস্যু নয়৷ দেখা যাচ্ছে, চিকিৎসক পুলিশকে অপমান করছে, পুলিশ রাজনীতিবিদদের হয়রানি করছে, রাজনীতিবদ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের গালমন্দ করছে, সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নিরীহ জনগণকে শাসাচ্ছেন৷ অর্থাৎ প্রত্যেকে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে ক্ষমতার প্রদর্শন করছেন৷ অর্মত্য সেন তাঁর ‘পরিচিতি ও সহিংসতা’ বইতে বলেছেন, প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে বিভিন্ন পেশার মানুষের এই রাজনৈতিক পরিচিতির বহিঃপ্রকাশ দীর্ঘদিনের অনিয়ম, অসততা আর দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার ফল৷ এটি মানুষের মানবিক জীবনযাপনকে ধীরে ধীরে তার সুষ্ঠু জীবনব্যবস্থা থেকে দূরে সরিয়ে দেয়৷ আত্মপরিচয়ের এই অহংবোধ এবং অন্যায্য চর্চার রাজনীতিক রূপটি যে অসম মানব ব্যবস্থা তৈরি করছে তাতে দেখা দিচ্ছে সংঘাত, বাড়ছে দূরত্ব৷ আত্মপরিচয়ের অহমিকায় ভোগা মানুষগুলোর জন্য দার্শনিক এরিক ফর্ম বলেছিলেন, ‘জন্মের আগেই অনেক মানুষ মারা যায়’৷
অপরিশীলিত বচসা ও উত্তেজিত ব্যবহারের পেছনে দায়ী বড় কারণটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত৷ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একদিকে যেমন নৈতিকতার শিক্ষার উপস্থিতি খুবই নগণ্য অন্যদিকে এ ব্যবস্থাটি সকল শিশু ও শিক্ষার্থীকে এক চোখে দেখে না৷ মাধ্যমিক স্তরে বিভাগ বন্টনের নামে যে বিভাজন আমরা তৈরি করি তার প্রভাব পরবর্তীতে কর্মক্ষেত্রে দেখো যাচ্ছে৷ পুরো দেশের কর্মশক্তিকে অঙ্কুরেই ভাগ করে ফেলছি ‘কম মেধাবী' ও ‘বেশি মেধাবী’ দুই ভাগে৷ এই বিভাজনের কারণে প্রশাসনে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য বাড়ছে৷ প্রত্যেক সংস্থা বা পেশার লোক নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে৷ জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক অনেক আগেই এভাবে ‘এক জাতির মধ্যে দুটি জাতি সৃষ্টি করা’ হচ্ছে বলে সাবধান করে গিয়েছেন৷ আমাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা সব স্তরে শিক্ষার ব্যবস্থা এমন যে, পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পেয়েও প্রকৃত শিক্ষিত হতে পারছে না৷ পুষ্টিকর খাদ্য যেমন সুখাদ্য তেমনি শিক্ষাকে হতে হয় মানসম্মত সুশিক্ষা৷ এই সুশিক্ষার অভাবে আমরা এখন আখতার হামিদ খানের মতো প্রশাসক কিংবা অধ্যাপক ইব্রাহিমের মতো চিকিৎসক আর পাচ্ছি না যাদের কাছে নিজের পেশাগত পরিচয়ের চেয়ে মানুষের সম্মানটা বড় ছিল৷ নিম্নমানের শিক্ষা দিয়ে নানা কায়দায় অর্থ কামানো যায়, গাড়ি-বাড়ি হাঁকানো যায়, কিন্তু যোগ্য ও উন্নত মানুষ হওয়া যায় না৷ বাংলার ভূখণ্ডের যে সামাজিক আচার ও রীতিনীতি তার নৈতিক বৈশিষ্ট্য হলো অহিংসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, অন্যের প্রতিবেশীর প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ৷ কিন্তু আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত উভয় ধরনের শিক্ষায় এসব নৈতিক বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি নেই বললেই চলে৷ সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর এক নিবন্ধে বলেছিলেন, নির্বিচারে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন জিপিএ যদি উনিশ শতকে থাকত, তাহলে মাইকেল, বঙ্কিমচন্দ্র, জগদীশ বসু তো দূরের কথা আক্কেল আলী বেপারীর মতো লেখকও আমরা পেতাম না; বাঙালি জাতি পড়ে থাকত মধ্যযুগে৷
এ ধরনের আচরণের জন্য দায়ী আরেকটি কারণ হলো পেশাজীবীদের রাজনৈতিক আনুগত্য৷ বাংলাদেশের পেশাজীবীরা দলীয় রাজনীতির সিন্ডিকেটের অংশ হয়ে গেছেন৷ শুধু চিকিৎসক বা সাংবাদিক নয়, শিক্ষক-আইনজীবী-ইঞ্জিনিয়ার-আমলাতন্ত্রসহ শিল্পী-লেখক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারাও দলীয় রাজনীতির অংশ এখন৷ সুষম গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অভাবে সরকারের সবচেয়ে কাছের বাহিনী বা সংস্থা হওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত রাষ্ট্রের সংস্থাগুলো৷ যারা পারছে না, তারা পেশাজীবী হিসেবে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় শক্ত করার চেষ্টা করছে, রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি করছে৷ প্রশাসনে অন্যায় করেও পার পেয়ে যাওয়ার মূল উপায় যখন আনুগত্য তখন তার চর্চা তো বাড়বেই৷ মানুষের শরীরের নানা অঙ্গের মতো যে কোন আদর্শ সমাজে সব পেশাজীবীর অবদান সমান গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হয়৷ কারণ সমাজের সফলতার জন্য সকলের সমঅংশগ্রহণ দরকার৷ বাংলাদেশের প্রতিটা শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি আছে৷ দুর্নীতি, অনিয়ম আর রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে গড়ে উঠা ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থায় আন্তঃপেশা সঙ্কট আরও বাড়বে৷
মধ্যবিত্ত শ্রেণী আমাদের সমাজের আয়না৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বভাব-চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য দিয়ে কোনো জাতিকে বিচার করতে হয়৷ একটা সমাজের চরিত্রের রূপ নির্ধারণ করে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী৷ তাই মানবিক গুণসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী ছাড়া ভালো সমাজ আশা করা যায় না৷ মানবিক গুণসম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণী একদিনে তৈরি হয় না৷ এর জন্য জাতির শিক্ষা, শিল্প-সাহিত্য, পাবলিক সার্ভিসসহ সবকিছুতে একটা ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হয়৷ মানুষ প্রথমে অভ্যাস তৈরি করে তারপর সে অভ্যাসের দাস হয়৷ আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে পেশাগত মানদণ্ড অনুসরণ করে নিজ নিজ কর্তব্য পালনের মধ্য দিয়ে জনসেবা করা নয়; বরং আত্মীয়তা, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করা৷
গ্রাম বাংলায় একটা কথা আছে, জঙ্গলের জন্য গাছ দেখা যায় না৷ অর্থাৎ বড় কোনো গাছের চারদিকে আগাছা ও ঝোপঝাড় থাকলে গাছটিকে দেখা যায় না বা তার বিরাটত্ব চোখে পড়ে না৷ যার অর্থ হলো, আবর্জনা ভালো জিনিসকে ধোঁয়াটে করে দেয়৷ নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থা আর সবকিছুতে রাজনৈতিক আনুগত্য আমাদেরকে আগাছা রূপী জঙ্গল উপহার দিচ্ছে৷ মহামারির সময় চিকিৎসক-পুলিশ-সাংবাদিক-মাঠের সরকারি কর্মকর্তা সম্মুখ যোদ্ধা হিসেবে যে অবদান রাখছে তা মানব জাতিকে আজীবন মনে রাখতে হবে৷ কিন্তু পেশাগত অহংবোধে সৃষ্ট উত্তেজনা আর দূরত্ব এবং সংঘাত মহামারির বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে কঠিন করে তুলবে৷ বাংলায় একটি প্রবচন আছে, ‘গড়ানো বাঁশ পাকে না'৷ বর্ষাকালে বাঁশের গোড়া থেকে কোড়ল বা কচি বাঁশ বের হয়৷ এগুলোর কোন কোনটি অনেক উঁচু হয়ে কাত হয়ে পড়ে যায়৷ এরপর আর বড়ও হয় না, পাকেও না৷ কোনো দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় ভেঙে পড়লে তার অবস্থা গড়ানো বাঁশের মতো হতে বাধ্য, সেখানে তখন জোর যার মুল্লুকই মূল সার হবে৷