মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসাটাই শিহরিত করে ডা. দীপাকে
১৮ জুন ২০১১১৯৫৩ সালের ২৮ অক্টোবর সিলেটে জন্ম হলেও পিতামাতার কর্মস্থল হিসেবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ডা. দীপা ইসলাম৷ কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, পিতা রুহিনী দাস এবং মাতা হেনা দাসের রাজনৈতিক জীবনের ছোঁয়া ছোট থেকেই প্রভাবিত করেছে দীপা ইসলামের কর্মকাণ্ডকে৷ ফলে কলেজ জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সাথে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন দীপা৷ তাঁর সংগ্রাম মুখর তারুণ্যের দিনগুলোর অধিকাংশই কেটেছে নারায়ণগঞ্জে৷
উনসত্তরের গণ আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রায় সকল আন্দোলনে সামনের সারির নেত্রী ছিলেন দীপা৷ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে একদিকে নকল বন্দুক নিয়ে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন৷ অন্যদিকে, সংস্কৃতি সংসদের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের মানুষকে অধিকার সচেতন করার কাজ করেছেন তিনি৷ ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে ঢাকায় প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন তিনি৷ তবে ২৫ মার্চ হঠাৎ করেই গণহত্যা শুরু হলে কিছুটা দলছুট হয়ে পড়েন দীপা৷ তখন বাবা-মায়ের নির্দেশনা অনুসারে যুদ্ধের প্রথম তিন মাস শীতলক্ষা বিধৌত বিক্রমপুরে থেকে কাজ করেন৷
এরপর মে মাসের শেষের দিকে সপরিবারে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন তাঁরা৷ কুমিল্লার রামচন্দ্রপুর, সিএন্ডবি সড়ক দিয়ে কসবা সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা গিয়ে পৌঁছান তাঁরা৷ সেখানে গিয়ে তাঁরা পুনরায় সুসংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করেন৷ কলকাতায় পৌঁছে নারীদের প্রশিক্ষণের জন্য গড়ে তোলা গোবরা শিবিরে চিকিৎসা সেবা ও সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন৷ প্রশিক্ষণ শেষে যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযানে অংশগ্রহণ করেন ডা. দীপা ইসলাম৷ এছাড়া ভারতের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ সংগ্রহ করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে সেগুলো বিতরণ করতেন তাঁরা৷
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাসের অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনার কয়েকটি তুলে ধরেন তিনি ডয়চে ভেলের কাছে৷ দীপা ইসলাম জানালেন, ‘‘বিক্রমপুর থেকে পায়ে হেঁটে যখন ভারত যাচ্ছিলাম, তখন বৃষ্টি-বাদলের মৌসুম ছিল৷ আমার বয়স কম ছিল বলে মনে নেই যে, ঠিক কতোটা দূরত্ব ছিল সেটা৷ ধান ক্ষেত দিয়ে হাঁটছি৷ তবে পথ চলতে চলতে কারো সাথে দেখা হলেই আমরা জিজ্ঞেস করতাম যে, আর কতো দূর৷ যাকেই জিজ্ঞেস করতাম সেই প্রায় একই উত্তর দিতো যে, আর পাঁচ মাইল৷ আর পাঁচ মাইল৷ কিন্তু এই পাঁচ মাইল আর শেষ হচ্ছিল না৷ এরপর প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে গ্রামের একটি কৃষক পরিবার এতোগুলো মানুষকে আশ্রয় দিল৷ অথচ আমাদের মধ্যে অনেকেই আবার সন্দেহ করছে যে, আশ্রয় দিয়ে আবার তারা আমাদেরকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয় কি না৷ তারপরও দেখা গেল গোয়াল ঘর থেকে শুরু করে নানা জায়গায় তারা আমাদের জন্য একটু থাকার এবং ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দিল৷ রান্না করে খাওয়ালো৷ তাদের যে এই সহানুভূতি এবং সহযোগিতা এটা সত্যিই দুর্লভ৷ কেউ কারো পরিচয় না জেনেও নির্বিশেষে সবার প্রতি এভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷''
এছাড়া আরেকদিনের ঘটনা স্মরণ করে এখনও শিউরে ওঠেন ডা. দীপা৷ তিনি বললেন, ‘‘কুমিল্লার সিএন্ডবি সড়ক দিয়ে যখন যাচ্ছিলাম তখন আমরা বুঝতেই পারিনি যে, কোন পথে যাচ্ছি৷ সেই পথেই দেখি পাক সেনারা টহল দিচ্ছে৷ তখন পড়ি-মড়ি করে ছুটে পালাতে হয়েছে৷ কারো কোন দিশা ছিল না যে কোথায় মা-বাবা কিংবা কোথায় ছোট ভাই-বোন৷ সবাই যে যার মতো দৌড়ে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছে৷ হঠাৎ দেখা গেল পাক সেনারা গাড়ি থেকে ব্রাশ ফায়ার করল৷ আমাদের পেছনে খুব কাছেই বেশ কিছু মানুষ গুলি খেয়ে পড়ে রইল৷ এতো কিছু পরেও কীভাবে যে আমরা বেঁচে গেছি সেটাও খুব আশ্চর্য লাগে৷''
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক