মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ ভুল!
১৭ মার্চ ২০১৬বুধবার কাশিমপুর কারাগারে জামায়াতে ইসলামির নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুপরোয়ানা পড়ে শোনানো হয়েছে৷ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পেয়েছে ঢাকার তথাকথিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ সেই প্রমাণের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ খুব তাড়াতাড়িই তাঁর ফাঁসি কার্যকর করা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
মাত্র কয়েকদিন আগে তিনটি আদালত একই দিনে এক কিশোর, এক কিশোরী ও এক নারীকে হত্যার অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় মোট ১৩ ব্যাক্তির বিরুদ্ধেও মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে৷ কিন্তু এই মৃত্যুদণ্ডগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার নজর কাড়েনি৷ অথচ তারা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়গুলোর নিন্দা জানিয়ে আসছে৷
এটা খুবই দুঃখজনক, কেননা এর ফলে বাংলাদেশে যা হচ্ছে সে সম্পর্কে এক ধরণের অস্পষ্টতা তৈরি হয়৷ এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের যে ২৩টি দেশ এখনো নিয়মিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, বাংলাদেশ তাদের একটি৷ মৃত্যুদণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে এই দেশটির রেকর্ড চীন, ইরান বা সৌদি আরব কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে খুব একটা ভালো নয়৷
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে যুক্তিটা খুব স্পষ্ট৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, মৃত্যুদণ্ড বেঁচে থাকার অধিকারকে খর্ব করে৷ তারা আরো মনে করে, মৃত্যুদণ্ড ‘একটি নিষ্ঠুর, অমানবিক ও মর্যাদাহানিকর শাস্তি'৷ এর ফলে অপরাধীকে যে শুধু হত্যাই করা হচ্ছে তা-ই নয়, মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আগে তাকে যে মানসিক ও অন্য কিছু কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ৷
মৃত্যুদণ্ড বেশি দেয়া হয় চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান এবং সৌদি আরবের মতো দেশে৷ সেসব দেশে এই দণ্ড দেয়া হয় মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মাঝে আতঙ্ক ছড়াতে৷ ২০১৩ সালে ইরান ও সৌদি আরবে যথাক্রমে ৩৬৯ ও ৭৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ অপরাধ সংঘটনের সময় যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল, এই দুটি দেশে তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেয় চীন৷২০১৩ সালে তারা এক হাজারেরও বেশি মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷ এক্ষেত্রে ইরান, উত্তর কোরিয়া, সৌদি আরব ও সোমালিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, তারা প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে৷ আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেয় সুদান৷ ইরাকেও অনেক মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ ২০১৪ সালে সে দেশে ১৬৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশও মৃত্যুদণ্ড দেয়৷ তথাকথিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল যে রায়গুলো দিচ্ছে সেসব নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ দেখে মনে হয়, এনসব দেশে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য বোধহয় প্রতিশোধ নেয়া, শাসক দলের দুর্নীতিগ্রস্থ সমর্থকদের মাঝে শৃঙ্খলা ফেরানো এবং বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসি শাসিত জার্মানিতেও এভাবেই মৃত্যুদণ্ডের প্রয়োগ হয়েছিল৷
মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতার আরেকটি কারণ হলো, এটি অপরাধীকে সংশোধনের সুযোগ দেয় না৷ এর ফলে যারা অপরাধের শিকার তারা হয়ত খুশি হয়, তাতে হয়ত তাদের প্রতিশোধের ইচ্ছাপূরণ হয়৷ তবে মামলার দীর্ঘসূত্রতা অনেক ক্ষেত্রে সব পক্ষের ভোগান্তিই বাড়ায়৷ আবার অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড ‘শহিদের' জন্ম দেয়, প্রতিশোধের ইচ্ছার পক্ষে যুক্তি তৈরি করে এবং আরো রক্তক্ষয়ের আশঙ্কা বাড়ায়৷
সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিশ্বের অনেক দেশেই বিচার প্রক্রিয়া এত ত্রুটিপূর্ণ যে অনেকক্ষেত্রেই অভিযুক্তের জন্য সুবিচারের নিশ্চয়তা থাকেনা৷ যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও দরিদ্র আর সংখ্যালঘুদের ঢালাওভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কিছু দেশে অপরাধ প্রমাণে গোয়েন্দারাও বিশেষ ভূমিকা রাখেন৷ অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষ ব্যক্তিকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ গত শতকে অন্তত এমন ১০০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, যাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া ছিল ভুল৷
কারাভোগরত অপরাধী অনেক সময়ই বদলে যায়৷ অনেক সময় দেখা গেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি তার অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চায়, সংশোধনের সুযোগ চায়৷ অনেকে সুযোগ পেলে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলে৷ কেউ বই লেখেন, কেউ বা ধর্মকর্ম শুরু করেন৷
কারাগারেও যাদের অনুশোচনা হয় না, তাদেরও মৃত্যুদণ্ড দিতেই হবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই৷ তাদের কারাগারে রেখে দিলেই তো সমাজকে তুলনামূলকভাবে কম খরচে এবং কার্যকরভাবে নিরাপদ রাখা যায়৷ দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মাত্রাতিরিক্ত খরচ৷ হত্যাকারীকে ফাঁসির দড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে যে পরিমাণ খরচ হয়, সেটা অপরাধের শিকার যারা, তাদের সহায়তায় ব্যয় করা হলেও সমাজ থেকে ধীরে ধীরে সন্ত্রাসের সংস্কৃতি মুছে যেতে পারে৷
এখনো যেসব দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করছে, তাদের জন্য বুদ্ধির কাজ হবে জার্মানির ১৯৪৯ সালের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করা৷ ধারাবাহিকভাবে মৃত্যুদণ্ডের এই প্রয়োগ একটি দুঃখজনক ভুল৷
আপনি কি গ্রেহেম লুকাসের সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷