1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুজিববর্ষ : হোক সকলের

১৭ জানুয়ারি ২০২০

ইতিহাসের সাথে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম৷ বয়োজ্যেষ্ঠ অনেককে বলতে শুনেছি, ‘বঙ্গবন্ধু না থাকলে আমরা স্বাধীন দেশ পেতাম না, এখনো হয়তো আমাদের পাকিস্তানের গোলামি করেই জীবন কাটাতে হতো৷'

https://p.dw.com/p/3WMHq
Bangladesch 100. Jubiläum Geburt von Sheikh Mujibur Rahman

বলার অপেক্ষা রাখে না, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিসংবাদিত নেতা৷ যাঁর সাথে বাঙালির রয়েছে আত্মার সংযোগ, যাঁর কাছে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে আত্মপরিচয়ের ঠিকানা৷  ইতিহাস বলে, হাজার বছর ধরে এই জাতি ও জনপদের অস্তিত্ব টিকে থাকলেও তা কখনোই স্বাধীন সার্বভৌম একক রাষ্ট্র ছিল না৷ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে বাঙালি জাতির স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখার সূচনা৷  ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বেই জনগণের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন৷ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার পেছনে স্থপতির ভূমিকায় যিনি ছিলেন এবং আপামর জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যিনি শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী অবশ্যই এদেশের মানুষের কাছে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা৷ এ উপলক্ষে ২০২০ ও ২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷ এদিকে, ইউনেস্কোও বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর জন্ম বার্ষিকী উদযাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ঘটনাটি একটি আর্ন্তজাতিক মাত্রা পেয়েছে৷ বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই আয়োজনে সব বয়স ও শ্রেণি পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন৷ ১০২ সদস্যের জাতীয় কমিটি, ৬১ সদস্যের বাস্তবায়ন কমিটিও গঠিত হয়েছে৷ দেশে বিদেশে মুজিববর্ষ উদযাপনের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে বলেও জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এই পরিকলপনায় বর্তমানে ২৯৮টি কর্মসূচি অর্ন্তভূক্ত রয়েছে৷

গত ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিবসে উৎসবমুখর বর্ণাঢ্য আয়োজনে মুজিব বর্ষের ক্ষণ গণণার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে৷ সেই অনুষ্ঠানে আরো অনেক পর্বের পাশাপাশি লেজার রশ্মির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রতীকী প্রত্যাবর্তনের আলোকোজ্জ্বল চিত্রটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল৷ যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে এই ইভেন্টটির সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, এতে দিনটির ভাব-গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ কেননা এর এনিমেশন পর্বটিকে অনেকের কাছেই অপরিপক্ক কাঁচা হাতের কাজ বলে মনে হয়েছে৷ সে যাই হোক, একটি বিশাল আয়োজনের সব অংশই যে নিখুঁত হবে বা সবার মনপুতঃ হবে তা নয়৷

সত্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমনই এক উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি নেতা তো ছিলেনই তার চাইতেও বেশি ছিলেন কোটি মানুষের মনের কাছাকাছি এক প্রাণের মানুষ, আপন মানুষ৷ সেই মহান বিশাল মানুষের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপন নিয়ে মানুষের প্রত্যাশাও কম নয়৷ ক্ষমতায় থেকে জাতির পিতার শতবর্ষ পালনের মুহূর্তকে জীবনের বড় প্রাপ্তি হিসেবেই মনে করছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা৷ তাঁর এই প্রাপ্তির আনন্দ নিশ্চয়ই দেশবাসীর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে৷         

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে কারো কোন প্রশ্ন আছে বলে মনে হয় না৷ যদিও তার স্বল্প শাসনকাল নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত৷ সত্যি বলতে, এই জনগোষ্ঠির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে মত পার্থক্য আছে, মতভিন্নতা আছে, বিভিন্ন রকমের চিন্তার দূরত্ব আছে, মানুষ ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর না হলে চিন্তার এই ভিন্নতাকে গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য বলেই চিহ্নিত করা হয়৷

Shahnaz Munni
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

গণতন্ত্রে মত বিরোধ থাকবে, মতবৈচিত্র্য থাকবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু তারপরও কিছু কিছু বিষয়ে ঐক্যমত্য হতেই পারতো৷ যাকে আমরা মহান নান্দনিক ঐক্যমত্য হিসেবে বিবেচনা করতে পারতাম৷ যেমন, এই দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর অবদান৷ দলীয় বিভাজন থেকে বেরিয়ে এসে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আজ যদি আমরা সবাই মিলে দলমত নির্বিশেষে জাতির জনকের জন্ম শতবার্ষিকী পালন করতে পারতাম তবে তা কত আনন্দেরই না হতো! নতুন প্রজন্মের সামনে উদারতা ও ঐক্যের দৃষ্টান্ত তৈরি হতো৷ এই উদযাপনের মধ্যে দলমত নির্বিশেষে এ জাতির প্রতিটি মানুষ সম্পৃক্ত হতে পারতো৷ বৃহত্তর ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এই দেশ, এই জাতি তাঁর প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করতে পারতো৷ কারণ, আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর নেতা নন, তিনি এদেশের সকল মানুষের হৃদয়ের নেতা, জনতার নেতা৷ শত বিপদ, নির্যাতন, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে তিনি জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন৷ একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন৷ তাঁর কাছে এই দেশের সবাই কৃতজ্ঞ৷ জন্মশতবার্ষিকী একত্রে উদযাপনের মাধ্যমে পুরো জাতি এই মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারতো৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য জনকভাবে আমাদের ঘৃণা ও বিভেদের শেকড় এত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে যে এই ঐক্যমত্যে আমরা সহসা পৌছাতে পারবো বলে বিশ্বাস হয় না৷ 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই নানা ভাবে তাদের জাতির মহান নেতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়৷ এই উদযাপনের অন্যতম লক্ষ্য থাকে কৃতি মানুষটির জীবনাদর্শ জনমানে ছড়িয়ে দেওয়া৷ নতুন প্রজন্মকে তার গুণে গুণান্বিত হতে উদ্বুদ্ধ করা৷ আমাদের এখানে অনেকেই ঢালাও ভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুসরণের কথা বলেন, কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও মূল্যবোধ বুঝতে গেলে শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়তে হবে৷ এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে তার জীবন দর্শন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ তিনি জনগণের জন্য রাজনীতি করেছেন, সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলেছেন৷ অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার পক্ষেই লড়াই করেছেন৷ এই অনন্য মানুষটি চেয়েছেন, বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, সুখী হোক, প্রাণ ভরে হাসুক, হেসে খেলে বেড়াক৷ আপাতদৃষ্টিতে এই চাওয়াগুলো হয়তো সামান্যই, কিন্তু গভীর ভাবে ভাবলে এই চাওয়াগুলির তাৎপর্য অসামান্য৷ দেশের সাধারণ মানুষদের কথা ভেবেছেন তিনি, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন৷ কিন্তু এই হাসি তখনই ফুটবে যখন সামগ্রিক ভাবে দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে, দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, সর্বস্তরে সবধরনের দুর্নীতি দূর হবে৷

সরকার দেশের জ্ঞানী-গুণিদের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী বিশ্বমানের আনুষ্ঠানিকতায় উদযাপন করছেন, করুন৷ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য সুন্দর, রুচিশীল ও পরিকল্পিত অনুষ্ঠানেরও প্রয়োজন আছে৷ পাশাপাশি তাঁর আজীবনের চাওয়া পূরণ করতেও সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন, আন্তরিকতার সাথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন করবেন, এমনটাই অনেকের প্রত্যাশা৷ কেননা তার স্বপ্নের বাংলা গড়াই চূড়ান্ত অর্থে তাঁকে সম্মান জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায়৷