মুখ্যমন্ত্রী ধর্নায়, দিল্লি অচলাবস্থায়
১৫ জুন ২০১৮মাত্রাতিরিক্ত দূষণে জেরবার ভারতের রাজধানীর জনজীবন৷ আগামী জুলাই থেকেই মারণরোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ থমকে আছে সাফাই অভিযান৷ নালা-নর্দমা ও নিকাশির দেখভাল স্তব্ধ৷ এইসব দেখভাল যাদের দায়িত্ব, সেই সরকার বসেছে ধর্নায়৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক ইতিহাস অবশ্য ধর্না, অনশন ও বিক্ষোভের গণ্ডি পেরিয়ে বেশিদূর এগোয়নি৷ অতীতে বেশ কয়েকবার তাঁকে এই ভূমিকায় দেখা গিয়েছে৷ কিন্তু, এবার মন্ত্রিসভার তিন সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে সোজা উপ-রাজ্যপালের আবাসনে গিয়ে হাজির সপার্ষদ মুখ্যমন্ত্রী৷ তাঁর বাড়ির সোফায় শুয়ে-বসে ধর্না শুরু করেছেন তাঁরা৷ একগুচ্ছ দাবি আদায় করেই তিনি ধর্না প্রত্যাহার করবেন বলে জানিয়েছেন৷
একদিকে ধর্নায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর তিন মন্ত্রী৷ দিল্লির নানা সমস্যা নিয়ে কেজরিওয়ালকে চেপে ধরতে উঠেপড়ে লেগেছে দুই বিরোধী দল বিজেপি, কংগ্রেস৷ অন্যদিকে, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অন্যান্য কয়েকটি আঞ্চলিক দল কেজরিওয়ালের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে সমর্থন করে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে৷ কেজরিওয়ালের সঙ্গে দেখা করেছেন সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাত৷ মমতা দিল্লির সমস্যা সমাধানে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চেয়ে টুইট করেছিলেন৷ তিনি লিখেছিলেন, ‘‘একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে সম্মান দেখানো উচিত৷ কেন্দ্রীয় সরকার এবং উপ-রাজ্যপালকে অনুরোধ, যত শীঘ্র সম্ভব এই সমস্যার সমাধান করুন৷'' আরএলডি-র সহ-সভাপতি জয়ন্ত চৌধুরী কেজরিওয়ালের সমর্থনে বলেছেন, ‘‘এই ঘটনায় প্রমাণিত হলো কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিরা শাসনভার পরিচালনায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ৷'' সমর্থন জানিয়েছেন আরএলডি প্রধান অজিত সিং৷ কেজরিওয়ালকে সমর্থন করে আরজেডি প্রধান মনোজ ঝা বলেছেন, তাঁর দল কেজরিওয়ালের পাশে আছে৷ এদিন সকাল থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন কেজরিওয়ালের দুই সঙ্গী উপ-মুখ্যমন্ত্রী মণীশ শিশোদিয়া এবং অপর মন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈন৷ সত্যেন্দ্রর রক্তচাপ ক্রমশ নিম্নগামী হওয়ায় তাঁকে পর্যবেক্ষণে রেখেছেন চিকিৎসকরা৷
দিল্লি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অজয় মাকেনের কথায়, ‘‘দিল্লিতে গত তিন দিন ধরে আশ্চর্যজনক ধর্না চলছে৷ গোটা দিল্লিতে নোংরা ছেয়ে গেছে৷ দুর্নীতিতে ডুবে গেছে আপ-সরকার৷ এইসব থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে উপ-রাজ্যপালের আবাসনে গিয়ে ধর্নায় বসেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ অন্যদিকে, বিজেপি'র কর্তারা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে ধর্নায় বসেছেন৷ এই দুই দলের ধর্না-রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে দিল্লিবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত৷'' মাকেনের দাবি, ‘‘১৯৯৮ সাল থেকে দিল্লিতে ১৫ বছর শীলা দীক্ষিতের সরকারের কাজের জন্য কংগ্রেসকে চিরকাল মানুষ মনে রাখবে৷ মেট্রো রেল, সিএনজি এবং বিদ্যুতে বিপ্লব এনে ইতিহাস গড়েছিলেন শীলা দীক্ষিত৷ সেই উন্নয়নের এক শতাংশও করতে পারেননি কেজরিওয়াল৷ ব্যর্থতা ঢাকতেই ধর্না নাটক করছেন তিনি৷''
প্রসঙ্গত, দিল্লিতে টানা প্রায় তিন মাস ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছেন আইএএস অফিসাররা৷ উপ-রাজ্যপাল অনিল বাইজাল সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন বলে অভিযোগ৷ এমনকী আধিকারিকদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের কোনও চেষ্টাই তিনি করেননি৷ উল্টে, প্রশাসনিক নিয়োগ ও রদবদলের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে সরকারের হাত থেকে৷
বিজেপি ও কংগ্রেসের বিস্তর অভিযোগ আম আদমি পার্টি এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে৷ সবটাই রাজনৈতিক৷ রাজনীতির কারবারিরা রাজনীতি করবেন, এ আর নতুন কি? বিরোধীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে আপ নেতা সঞ্জয় বসু জানালেন, ‘‘সরকারের ব্যর্থতা বা সার্থকতা বিচার করতে হলে সরকারের বার্ষিক বাজেটের দিকে তাকানো উচিত৷ প্রশ্ন হল, কেন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে কেন ধর্ণায় বসতে হল? আসলে আইএএস আধিকারিকদের একাংশ গত তিনমাস ধরে কর্মবিরতি পালন করছে৷ এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে৷ ওই আধিকারিকদের মদত দিচ্ছেন উপ-রাজ্যপাল৷ আবার উপ-রাজ্যপালকে সরাসরি মদত দিচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর৷ আমলারা মুখ্যমন্ত্রীর কথা না শুনলে, সরকার চলবে কীভাবে? পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা-সহ ইত্যাদি বিষয়ে নিয়মিত বৈঠক না হলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ তা-ই হচ্ছে৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দপ্তর থেকে সবটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ প্রতিবাদে বাধ্য হয়ে ধর্নায় বসতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীকে৷''
যে বিষয়ে আমলারা কর্মবিরতি পালন করছেন তা হল, আপ বিধায়কদের হাতে মুখ্যসচিবকে হেনস্থা করার ঘটনা৷ সঞ্জয় বসুর বক্তব্য হল, ‘‘আমলারা দেশের আইনের ওপর ভরসা রাখুন না৷ মুখ্যসচিবকে হেনস্থার অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে দিল্লি পুলিশ৷ দুই বিধায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে জেরা করেছে পুলিশ৷ এখন আমলাদের এইভাবে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ধর্না ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না৷''
বিজেপি-কে পাল্টা চাপে ফেলে উপ-রাজ্যপালের বাড়ির সোফায় বসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখেছেন কেজরিওয়াল৷ উপ-রাজ্যপালের অসহযোগিতা এবং আইএএস আধিকারিকদের দীর্ঘ কর্মবিরতির প্রতিকারে মোদির হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তিনি৷ লিখেছেন, আমলাদের ধর্মঘটের কারণে গত তিন মাসে দূষণ নিয়ে কোনও বৈঠক করা সম্ভব হয়নি৷ বর্ষা আসছে৷ নর্দমা সাফাই-সহ চিকুনগুনিয়ার মতো অসুখ প্রতিরোধ করতে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার বৈঠক করা সম্ভব হয়নি আমলাদের ধর্মঘটের জন্য৷ এর পেছনে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে এদিন সন্ধ্যায় রাজপথে মোমবাতি মিছিল বের করেছিল আম আদমি পার্টির সমর্থকরা৷ কেজরিওয়াল হুমকি দিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর অভিযান করবেন তিনি৷
রাজীব চক্রবর্তী, নতুনদিল্লি