সহিংসতা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে
১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অবস্থান
সহিংসতার কারণে ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষের বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ৷ মিয়ানমারে চলা এই সহিংসতার বিরুদ্ধে গত ৯ বছরের মধ্যে এই প্রথম এত শক্তিশালী অবস্থান নিল জাতিসংঘ৷ ব্রিটেনের জাতিসংঘ রাষ্ট্রদূত ম্যাথু রাইক্রোফট এক বিবৃতিতে বলেছেন, ন'বছরের মধ্যে এটা জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ৷ মহাসচিব নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যেখানে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি এবং অবিলম্বে সেখানে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ ১৯৮৯ সালের পর থেকে এই প্রথম কোনো জাতিসংঘ মহাসচিব এমন পদক্ষেপ নিলেন৷ ২০০৮ সালের পর থেকে মিয়ানমার পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্য কখনোই একমত হতে পারেনি৷ কেননা চীন বরাবরই মিয়ানমার সরকার এবং সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়ে আসছে৷
বুধবার নিরাপত্তা পরিষদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়৷ এতে রাখাইনে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের কারণে ৩ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়৷ এরপর সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে এক বিবৃতিতে ওই উদ্বেগ, নিন্দা ও আহ্বানের কথা জানান৷ সেই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক সহায়তাকর্মীদের প্রবেশের সুযোগ দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়৷
বৈঠক শুরুর আগে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘‘আমি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া ব্যক্তিদের ফেরার অধিকার স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি৷''
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘জাতিগত নির্মূলের' শিকার হচ্ছে কিনা, এমন এক প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, ‘‘যখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে, তখন সেই পরিস্থিতি তুলে ধরতে এর চেয়ে ভালো কোনো শব্দ আপনি কি খুঁজে পাবেন?'' তিনি এ সময় রাখাইনে ‘গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে' মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান৷ সেই সঙ্গে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেওয়া অথবা এমন কোনো আইনি মর্যাদা দেওয়ারও আহ্বান জানান, যাতে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন৷
নিরাপত্তা পরিষদের এক কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন আরো কঠোর বিবৃতির আহ্বান জানিয়েছিল৷ কিন্তু চীনসহ নিরাপত্তা পরিষদের আরো কয়েকটি সদস্য দেশ এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে মিয়ানমার সরকার এবং সেনাবাহিনীর কাছে সহিংসতা বন্ধে এই বার্তাই যথেষ্ট৷
মিয়ানমারের সরকার বুধবার জানায় যে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি এবারের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যোগ দিচ্ছেন না৷ জাতিসংঘ মহাসচিব বলেছেন, সু চির সফর বাতিলের ঘোষণার আগে তিনি তাঁর সঙ্গে এই ট্র্যাজেডি নিয়ে বেশ কয়েকবার কথা বলেছেন৷
নোবেল বিজয়ীদের খোলা চিঠি
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংকট নিরসনে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপে চেয়ে বুধবার খোলা চিঠি লিখেছেন নোবেলজয়ী ও বিশিষ্টজনরা৷ চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন ১২ নোবেলজয়ী, ১৫ বিশিষ্টজন৷ এঁদের মধ্যে শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রয়েছেন৷ সেখানে বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইনে যে মানবিক সংকট ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ভয়ংকর রূপ নিয়েছে – তার অবসানে জাতিসংঘের জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন৷
কক্সবাজারে পৌঁছাচ্ছে আন্তর্জাতিক ত্রাণ
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্য জরুরি ভিত্তিতে পানি ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম বহনকারী ইউনিসেফ-এর ট্রাক আজ কক্সবাজারে যাচ্ছে৷ আগামী দিনগুলোতে আরও জরুরি ত্রাণ সরবরাহ করা হবে বলে জাতিসংঘের এই সংস্থার এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে৷ জরুরি এসব সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে – ডিটারজেন্ট পাউডার, সাবান, পরিষ্কার রুমাল, তোয়ালে ও স্যান্ডেল৷ এছাড়া ইউনিসেফ পানি শোধন ও পরিবহনের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে সহায়তা করছে এবং নলকূপ বসানোর ক্ষেত্রেও সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়৷
মিয়ানমারে সহিংসতার মুখে গত ২৫ অগাস্ট থেকে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে, যাদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু বলে প্রাথমিক ধারণা৷ বিপুল সংখ্যক এই শরণার্থীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার ও শরণার্থী সংস্থাগুলো৷ আগামী চার মাসের জন্য রোহিঙ্গা শিশুদের সহায়তায় ইউনিসেফ ৭৩ লাখ ডলার সাহায্য চেয়েছে৷
বিভিন্ন মহলে সমালোচনার মুখে পড়া ভারত সরকার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশে ত্রাণ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এই ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে খাদ্যের পাশাপাশি থাকছে ওষুধপথ্য, মশারি ও অস্থায়ী শিবির তৈরির সরঞ্জাম৷ ভারতের ত্রাণসামগ্রী স্থল, জল ও আকাশপথে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে৷ অন্যদিকে, এরইমধ্যে ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশ মরক্কো৷ বৃহস্পতিবার সকালে ১৪ টন ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে মরক্কো এয়ারের একটি বিমানে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আর্ন্তজাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে৷
মিয়ানমারের ১৭৬টি গ্রাম জনশূন্য
মিয়ানমারের রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে দেশটির রাখাইন রাজ্যে ৪৭১টি রোহিঙ্গা গ্রামের মধ্যে ১৭৬টি গ্রাম পুরোপুরি জনশূন্য হয়ে গেছে৷ এছাড়া আরও ৩৪টি গ্রাম আংশিকভাবে জনশূন্য হয়েছে৷ রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মুখপাত্র জানান, গত ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে৷ তবে এরপর আর কোনো সংঘর্ষ হয়নি৷ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে, তাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে৷ এমনকি রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়ি-ঘর না ছাড়লে মরতে হবে এমন হুমকিও দেওয়া হয়েছে৷
এপিবি/ডিজি (এপি, এএফপি, রয়টার্স)
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আপনার মন্তব্য পাঠান, লিখুন নীচের ঘরে৷