মিডিয়াকে এড়িয়ে কি ব্যর্থতা লুকাতে পারবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী?
১৬ জুলাই ২০২১বরং বিপদ আরো বেড়েছে। বৃহস্পতিবারও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২২৬ জন, যা এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সামান্য সফল হলেও তার কৃতিত্ব যেমন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রাপ্য, তেমনি ব্যর্থতার দায়ও নেয়া উচিত তার। সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রায় দেড় বছরেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি তো হয়ইনি, বরং অবনতিই হচ্ছে। আপাতত উন্নতির কোনো আশার কথা শোনাতে পারছেন না কেউ। করোনার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া পরিকল্পনা, সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলার জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দৃশ্যত ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তিনি এড়িয়ে গেছেন।
অবশ্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী সব সময়ই সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলেন। এটি নতুন কিছু নয়। সংবাদ সম্মেলনে নিজে কথা বলেন, কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেন না। তারপরও ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে সরাসরি সঙ্গে কথা বলতে গত সোমবার তার মোবাইলে ফোন করলে ব্যস্ত পাওয়া যায়। টানা তিন দিন এভাবে চেষ্টা করা হয়েছে, প্রত্যেকবার ব্যস্তই পাওয়া গেছে। বিকল্প হিসেবে তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রথমে কয়েকদফা মেসেজ এবং পরে দফায় দফায় কল করলেও তিনি ধরেননি। দু-একবার ফোন রিসিভ করে কেটে দিলেও পরে নিজে তো কল দেনইনি, পরবর্তীতে আবার চেষ্টা করা হলেও ধরেননি৷
নিরুপায় হয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাইদুল ইসলাম প্রধানের সঙ্গে কথা বলা হয়। তিনি জানান, করোনা আক্রান্ত হয়ে তার বাবা মারা গেছেন। তাই তিনি গ্রামের বাড়িতে আছেন। বিকল্প কোনো মাধ্যমে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য পেতেই হবে। তাকে পেতে এবার চেষ্টা তার ঘনিষ্ট সাংবাদিকের মাধ্যমে। ওই সাংবাদিক জানান, "মন্ত্রীর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তিনি বিদেশি গণমাধ্যমে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। বিদেশি গণমাধ্যম নাকি দু-একটি পয়েন্ট ধরে এমন কিছু লেখে যাতে তিনি বেকায়দায় পড়েন। তাকে আশ্বাস দেয় হয়েছে এমন কিছু হবে না। তাই তিনি ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছেন। তবে শর্ত দিয়েছেন আগে প্রশ্ন দিতে হবে এবং লিখিত প্রশ্নের বাইরে আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। তাহলেই তিনি কথা বলবেন।”
সোমবার রাতেই মন্ত্রীর হোয়াইসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হয়। পাঠানো হয় ওই সাংবাদিককেও। মঙ্গলবার সকালে ফোনে ইন্টারনেট অন করলেও প্রশ্ন ‘সিন' হয়নি। আবারও যোগাযোগ ওই সাংবাদিকের সঙ্গে। দুপুরের দিকে তিনি জানালেন, মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন পেয়েছেন। সুবিধামতো সময়ে তিনি ফোন করে কথা বলবেন। অপেক্ষা করতে করতে মঙ্গলবার সন্ধ্যা। আবারও যোগাযোগ ওই সাংবাদিকের সঙ্গে। তখন তিনি জানালেন মন্ত্রীকে তিনিও ফোনে পাচ্ছেন না। রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেও তিনি আর মন্ত্রীকে ধরতে পারেননি। অগত্যা বিকল্প হিসেবে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফারুক আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
বুধবার সকালে ফারুক আহমেদকে ফোন করলে তিনি পরিচয় জেনে বলেন, মন্ত্রীকে তিনি বলবেন। তাকেও আবার প্রশ্ন পাঠানো হয়। দিনভর কয়েকদফা যোগাযোগ। বিকেলে ফারুক বললেন, "আমি আপনার প্রশ্ন এবং ফোন নম্বর মন্ত্রীর টেবিলে দিয়েছি। আজ তো অনেকগুলো মিটিং আছে, মন্ত্রী মহোদয় ফ্রি হয়ে আপনাকে ফোন করবেন।” কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষার পরও মন্ত্রীর ফোন আর আসে না। এর মধ্যেই আরো কয়েকদফা কথা হয় ফারুক আহমেদের সঙ্গে। তিনি নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে বলেন, "আমি তো মন্ত্রী মদোহয়কে যেভাবে বলার বলেছি। এর চেয়ে তো বেশি বলতে পারি না। ফলে আমি আর কী বলবো?”
এত চেষ্টার পরও বক্তব্য পাওয়া গেল না স্বাস্থ্য খাতের অভিভাবকের। চারদিন ধরে নানাভাবে অনবরত চেষ্টা করেও না পেয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়ে তারও উত্তর না পাওয়ায় মনে হলো তিনি আসলে কৌশলে এড়িয়েই গেছেন। করোনা সংক্রমণ শুরুর তিন মাস পর গত বছরের জুনে ধরা পড়ে ভুয়া হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। সেই হাসপাতাল পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দিচ্ছে। এই অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের মো. সাহেদ বা জেকেজির ডা. সাবরিনা চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে র্যাব ও পুলিশ। সেই চুক্তিগুলো হয়েছিল স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। ওইসব কেলেঙ্কারির দায় নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদকে। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বহাল আছেন!
গত মাসেই স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম নিয়ে জাতীয় সংসদে তুমুল আলোচনা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারিকালে অক্সিজেন সংকট, সংসদে দেওয়া তার বক্তব্যের জের ধরে অনির্ধারিত আলোচনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তুলাধুনা করেছেন বিরোধী দলের সদস্যরা। ব্যর্থতার দায় নিয়ে তার পদত্যাগের দাবিও করেন অনেকে।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে ‘আবিস্কার' হলো, গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত শেখ সায়েরা খাতুন হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভাগ্নে রায়ান হামিদের প্রতিষ্ঠান ‘বিডি থাই কসমো লিমিটেড' ১৫ ওয়াট বাথরুম লাইটের দাম ধরেছে ৩ হাজার ৮৪৩ টাকা, যার বাজারদর ২৫০ থেকে সর্বোচ্চ ৫৫০ টাকা। ১৮ ওয়াট এলইডি সারফেস ডাউন লাইটের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৫১ টাকা, অথচ বাজারদর সর্বোচ্চ ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এলইডি ওয়াল স্পট লাইট ১ হাজার ৫৫৬ টাকা ধরা হলেও বাজারদর ৩০০-৪০০ টাকা। এমন ২৪ ধরনের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম অস্বাভাবিক দামে সরবরাহ করবে প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে এখন দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। যদিও প্রতিষ্ঠানটির দাবি এসব অভিযোগ ঠিক নয়।
এতকিছুর পরও বহাল আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী! এড়িয়ে চলছেন গণমাধ্যম। সাংবাদিকদের এড়িয়ে গিয়ে কি নিজের ব্যর্থতা লুকাতে পারবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জনাব জাহিদ মালেক?