মিটফোর্ডে নকল ওষুধের আড়ত, ঠেকাতে আইনি তৎপরতা কম
২২ আগস্ট ২০২১এসব ওষুধ বিপণনের জন্য রয়েছে বিশেষ নেটওয়ার্ক। সেই নেটওয়ার্কের কেন্দ্র ঢাকার মিটফোর্ডের ওষুধের পাইকারি বাজার। ওষুধ ব্যবসায়ীদেরই কেউ কেউ এই নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অভিযানে এসব বিষয় বেড়িয়ে আসলেও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হচ্ছে না অপরাধীদের।
অভিযোগ আছে যে, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এ বিষয়টি নজরদারির দায়িত্বে থাকলেও, উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখছে না প্রতিষ্ঠানটি। ফলে সাধারণ মানুষ না জেনেই এমন নকল ওষুধ সেবন করছেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ ১৪ আগস্ট নকল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে আটজনকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশের অভিযানে বিপূল পরিমান নকল ওষুধও উদ্ধার হয়। যাদের গ্রেপ্তার করা হয়, তারা হলেন রবিন, ফয়সাল মোবারক, নাসির, ওয়াহিদুল, মামুন, ইব্রাহিম, আবু নাঈম ও ফয়সাল।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ জানান, এদের মধ্যে ফয়সাল মোবারক ৫-৬ বছর ধরে পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্পনগরীতে ৯ হাজার স্কয়ার ফুটের একটি ইউনানি ওষুধ তৈরির কারখনার আড়ালে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের নকল ওষুধ তৈরি করছিল। সেখানে অভিযান চালিয়ে নকল ওষুধ এবং যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
পুলিশের অভিযোগ, এই নকল ওষুধ বিপণনের জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন রবিন। তিনি ঢাকার মিটেফোর্ড এলাকার বিল্লাল শাহ পাইকারী ওষুধ মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক। মিটফোর্ড এলাকা থেকেই তিনি নকল ওষুধ সারাদেশে পাঠাতেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে ওষুধের কথিত কেমিকেল, স্ট্রিপ বা মোড়ক বানানোরও আলাদা লোক আছে। পুলিশের অভিযানে তাদেরও আটক করা হয়েছে।
সাইফুর রহমান জানান, বিভিন্ন কোম্পানির মর্কেট লিডার যে ওষুধগুলো তার নকল তৈরি করে এ চক্রটি। যেমন স্কয়ার কোম্পানির গাস্ট্রিকের ওষুধ সেকলো, ইনসেপ্টার মন্ট্রিয়ার, একমির মোনাস ইত্যাদি।
মন্টিলুকাস-১০ নামের একটি ওষুধ ডাক্তাররা করোনা চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করে থাকেন। এ ওষুধটিরও নকল তৈরি করেছে চক্রটি। যে সময় যেই ওষুধের চাহিদা বেশি, তারা সেই ওষুধগুলো নকল করে। নকল হলেও এমন নিখুঁতভাবে তারা কাজটি করে থাকে যে বাইরে থেকে দেখে আসল-নকল বোঝার উপায় নেই।
এইসব নকল ওষুধ তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে। ওষুধ স্টক না করে বরং চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর দাম কম হওয়ায় এক শ্রেনির ওষুধ বিক্রেতা বেশি লাভের জন্য এই নকল ওষুধ নেন।
গোয়েন্দা বিভাগ ঢাকা ও সাভার থেকেও নকল ওষুধ উদ্ধার করেছে। সাইফুর রহমান বলেন, "প্রধানত ইউনানি ওষুধের লাইসেন্স-এর আড়ালে এই নকল ওষুধ তৈরি করা হয়। আরো চক্র আছে। তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।”
একইভাবে রাজশাহী এলাকায়ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানা পাওয়া গেছে। গত ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে নকল ওষুধ তৈরির কারখানা সন্ধান পাওয়া যায়। অভিযানের সময় দুইজনকে আটক, বিপূল পরিমান নকল ওষুধ এবং প্রায় কোটি টাকা দামের নকল ওষুধ প্যাকেট করার যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়। রাজশাহীর এ চক্রটিও স্কয়ার, নাভানা ও ইনসেপ্টাসহ নামি-দামি ব্র্যান্ডের নকল ওষুধ তৈরি করছিল বলে জানায় পুলিশ।
এখান থেকেই ঢাকা মিটফোর্ড এলাকার নকল ওষুধের পাইকারী বাজার সম্পর্কে জানতে পারে পুলিশ। রাজশাহী গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার আরেফিন জুয়েল বলেন, "এখানে নকল ওষুধ প্যাকেটজাত বা স্ট্রিপে ভরা হতো। তারা নকল ওষুধ আনত ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার পাইকারী ওষুধের বাজার থেকে। সেখানে পাকেট ও স্ট্রিপ ছাড়াও নকল ওষুধের বাজার আছে। ওই বাজার থেকেই চক্রগুলো নকল ওষুধ কেনে। রাজশাহীতে এনে প্যাকেটজাত করে। আর সারা দেশের ফার্মেসিতে পাঠানো হয় কুরিয়ার ও এজেন্ট-এর মাধ্যমে। বিপণনের সাথে কিছু সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভও জড়িত।”
বাংলাদেশে নকল বা ভেজাল ওষুধের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলার বিধান আছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এখনো এই আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধের ব্যাপারে কেউ শাস্তি পেয়েছেন এমন নজির নেই বলে জানান তিনি।
এ আইনজীবী বলেন," এই আইনে মামলা হয় খুবই কম। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ছেড়ে দেয়া হয়। তাই নকল ও ভেজাল ওষুধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।”
তিনি অভিযোগ করেন, "এই বিষয়ে নজরদারির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব পালন করছেনা।”
এব্যাপারে কথা বলার জন্য চেষ্টা করেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য পাওয় যায়নি। তবে সহকারী পরিচালক মো. মুহিদ ইসলাম জানান, "প্রচলিত আদালত ছাড়াও নকল ও ভেজাল ওষুধ নিয়ে ড্রাগ কোর্টে মামলা করা যায়। আর মোবাইল কোর্টতো আছেই। তবে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলায় শাস্তি বেশি। এই আইনে ওষুধ প্রশাসনকে মামলা করতে হলে মহাপরিচালকের অনুমোদন লাগে।”