মার্টিন লুথার: এক অসন্দিগ্ধ বিপ্লবী
১ নভেম্বর ২০১৬সন্ন্যাসী মার্টিন লুথার শুধু চেয়েছিলেন ক্যাথলিক চার্চে তাঁর দেখা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে৷ কিন্তু ১৫১৭ সালের ৩১ অক্টোবর ভিটেনব্যার্গে যা ঘটেছিল, তা শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপ এবং খ্রিষ্টান বিশ্বে পরিবর্তন এনেছিল৷ মার্টিন যে পরিবর্তন এনেছিলেন, সেটা জানতে একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক৷
মধ্যযুগের শেষের দিকে এবং আধুনিক যুগের সূচনায় খ্রিষ্টানদের ধর্মবিশ্বাস রোমান ক্যাথলিক চার্চগুলো দ্বারা প্রভাবিত ছিল৷ চার্চের মতবাদ এবং নিয়মনীতি মানুষের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করতো এবং ঈশ্বরকে দেখা হতো এক জাজমেন্টাল চরিত্র হিসেবে যিনি কোন ভুলেই ক্ষমা করেন না৷ এমনকি যেসব ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া যেতো না, যেমন ব্যক্তিগত বিয়োগান্তক ঘটনা, মন্দ ফলন কিংবা যুদ্ধ এসবকে দেখা হতো শয়তানের সঙ্গে সম্পর্কে পরিণতি হিসেবে৷
বিদ্যুৎ চমকে আহত মার্টিন লুথার
এক খনি শ্রমিকের সন্তান হিসেবে ১৪৮৩ সালে আইসলেবেনে জন্মগ্রহণ করেন মার্টিন লুথার৷ ১৫০১ সালে তিনি এয়ারফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন৷ চারবছর পর মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি এবং আইন বিষয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন৷
সেসময় এক ঘটনা লুথারের জীবন বদলে দেয়৷ ১৫০৫ সালের জুলাইয়ে এক বড় ঝড়ের কবলে পড়েন তিনি এবং বজ্রপাতে আহত হন৷ সেই ঘটনায় জীবননাশের ঝুঁকিতে থাকাকালে তিনি অপ্রস্তুত অবস্থায় ঈশ্বরে সামনে দাঁড়ানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন৷ সেসময় তিনি সেইন্ট আনাকে ডাকেন এবং সন্ন্যাসী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন৷
সন্ন্যাসী হিসেবে লুথারের জীবন শুরু
আশ্রমে শুরু থেকেই তরুণ এই সন্ন্যাসী লক্ষ্যণীয়ভাবে অনুগত ছিলেন৷ ফলে আশ্রমে প্রবেশের দুই বছরের মাথায় ১৫০৭ সালে তাঁকে যাজক ঘোষণা করা হয়৷ ধর্মতত্ত্বীয় শিক্ষা দেয়া তাঁর গবেষণার মূল বিষয় ছিল এবং তিনি তা ভালোবেসেই করতেন৷
অর্থের বিনিময়ে পাপমুক্তির প্রথম অভিজ্ঞতা
অগাস্টিনের নির্দেশে ১৫১০ সালে রোমে যান লুথার৷ সেসময় সেন্ট পিটার্স বাসিলিকার ব্যয়বহুল নির্মাণ কাজের জন্য অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে ভ্যাটিকানের পাপাল কোর্ট কুরিয়া৷ অর্থের যোগান বাড়াতে চার্চের নেতারা তখন অর্থের বিনিময়ে পাপমোচনের উপায়ে বের করেন৷ খ্রিষ্টানদের জানানো হয় যে তারা চাইলে ভালো কাজ করে কিংবা অর্থের বিনিময়ে পাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন৷ আয় অনুযায়ী, কত টাকা দিতে হবে তাও নির্ধারণ করে দেয়া হয় তখন৷ এমনকি মৃতব্যক্তির আত্মীয়স্বজনরাও চাইলে সেই ব্যক্তির পাপমোচনে অর্থ ব্যয়ের সুযোগ করে দেয়া হয়৷
রোমে পাপমোচনের এই পন্থা ইতিবাচকভাবে নেননি লুথার৷ ২০১২ সালে ধর্মতত্ত্বে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন তিনি এবং ভিটেনব্যার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন তিনি৷ সেসময় গবেষণার এক পর্যায়ে লুথার বুঝতে পারেন, ঈশ্বর শুধু একজন বিচারক নন, তিনি একজন পিতাও যে কিনা তাঁর সন্তানদের ভালোবাসেন৷ সেসময় ধর্মবিশ্বাসের চারটি স্তম্ভ নির্ধারণ করেন তিনি৷ প্রথমটি হচ্ছে পবিত্র শাস্ত্র৷ তিনি বাইবেলকে ধর্মবিশ্বাসের একমাত্র বেঞ্চমার্ক হিসেবে বিবেচনা করেন, যদিও সেসময় চার্চগুলো পোপ এবং গির্জা-পরিচালকদের সম্মেলন থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য নির্দেশনাও অনুসরণ করতো৷ দ্বিতীয়ত, তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে পরিত্রাণ শুধুমাত্র ঈশ্বরের দয়ার মাধ্যমে ঘটতে পারে, ভালো কাজের বিনিময়ে নয়৷ তাঁর এই বিশ্বাস তখন অর্থের বিনিময়ে পাপমোচনের পন্থাকে অর্থহীন করে দেয়৷ তৃতীয়ত, লুথার সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, মানবতা এবং ঈশ্বরের মধ্যকার একমাত্র ব্রিজ হচ্ছেন যিশু খ্রিষ্ট৷ আর চতুর্থত, তিনি বিশ্বাস করেন যে আমরা শুধুমাত্র বিশ্বাস দ্বারা সংরক্ষিত৷
ধর্মতত্ত্বের শিক্ষক মার্টিন লুথার তাঁর এসব বিশ্বাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং ধর্মসভায় প্রচার করতে থাকেন৷ শুরুর দিকে কেউ এটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও একসময় চার্চের টনক নড়ে৷ আর সেসময় অর্থের বিনিময়ে পাপমোচনের বিষয়টি জার্মানিতে এক সাধারণ ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল৷ ১৫১৭ সালের অক্টোবরে এই বিষয়ে এক বিতর্কের আয়োজন করেন লুথার৷ কিন্তু সেখানে কেউ হাজির হননি৷ ফলে তিনি তাঁর থিসিস ব্রান্ডেনবুর্গের কার্ডিনাল আলবার্ট, ইলক্টর এবং মাইনৎসের আর্চবিশপের কাছে পাঠিয়ে দেন৷ পাশাপাশি চার্চের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেন থিসিসটি যাতে কেউ চাইলে পড়তে পারেন৷
বিষয়টি তখন চার্চের মূল ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেয়৷ সর্বত্র শুরু হয় বিতর্ক৷ মার্টিন লুথারও তখনকার সময়ের তুলনামূলকভাবে নতুন প্রিন্টিং প্রেসের কল্যাণে তাঁর বার্তা দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন৷
গত ৩১ অক্টোবর ছিল লুথারের সেই বিপ্লবে পাঁচশতম বার্ষিকী যার মাধ্যমে প্রোটেস্টানিজমের সূচনা ঘটে৷ এই উপলক্ষ্যে জার্মানিতে বছরব্যাপী বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে৷
ক্লাউস ক্রামার/এআই