1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানুষের মাঝেই যেন 'ঈশ্বর', প্রমাণ করলেন তাবলিগের প্রচারকরা

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
২৮ এপ্রিল ২০২০

১২৯ জন তাবলিগের প্রচারক চিকিৎসার স্বার্থে নিজেদের রক্ত দিতে রাজি হয়েছেন। করোনা হয়েছিল তাঁদের। এখন সুস্থ। ডাক্তাররা তাঁদের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করবেন।

https://p.dw.com/p/3bV7p
ছবি: picture-alliance/AP/A. Solanki

১৮৯৮ সাল। গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে প্লেগ মহামারি। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে আছে মৃতদেহ। ঘরে ঘরে আতঙ্ক। প্লেগ থেকে বাঁচতে সে দিন বাংলা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন বহু মানুষ। তেমনই দুর্দিনে স্বামী বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা রাস্তায় নেমেছিলেন সাধারণ মানুষের সেবার কাজে। প্লেগ এবং গুজবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি ম্যানিফেস্টো বা ইস্তাহার লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। আরও অনেক উপদেশের সঙ্গে সেখানে বলা হয়েছিল, পালিয়ে যাবেন না। মানুষের সেবার কাজে নামুন। কারণ মানুষের ভিতরেই ঈশ্বর আছেন। রোগ জর্জরিত মানুষের সেবা করার অর্থই হলো ঈশ্বরের সেবা করা।

দীর্ঘ ১২২ বছর পরে দিল্লিতে করোনায় আক্রান্ত তাবলিগ-ই-জামাতের প্রচারকরা সে কথাই যেন ফের একবার বুঝিয়ে দিলেন নিজেদের মতো করে। বুঝিয়ে দিলেন, যতই গুজব ছড়াক, এক শ্রেণির রাজনীতি যতই তাঁদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করুক, মানবসেবাই আসলে সব চেয়ে বড় ধর্ম। দিল্লির এইমস এবং ঝাজ্জর হাসপাতালে ভর্তি ১২৯ জন তাবলিগের সদস্য জানিয়েছেন, প্লাজমা চিকিৎসার জন্য তাঁরা রক্ত দিতে চান। যাতে তার সাহায্যে আরও অনেক করোনা রোগীকে সুস্থ করে তোলা যায়।

মার্চের মাঝামাঝি সময়ে, লকডাউন শুরু হওয়ার আগে দিল্লির নিজামুদ্দিন অঞ্চলে তাবলিগের মারকাজে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। দেশ বিদেশ থেকে কয়েক হাজার প্রচারক সেখানে যোগ দিয়েছিলেন। মার্চের শেষ সপ্তাহে জানা যায়, সেই সমাবেশে যোগ দেওয়া বহু প্রচারক করোনা-আক্রান্ত। যা নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিভেদমূলক রাজনৈতিক আক্রমণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ভুয়া খবর, ছবি। ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয় সমাজ। রাজনীতি রাজনীতির পথে হেঁটেছে। মানব ধর্ম মানব ধর্মের পথে। তাবলিগের প্রচারকরা সে কথা আরও একবার শুধু বুঝিয়ে দিলেন না, জিতিয়ে দিলেন মুনুষ্যত্বকে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত সপ্তাহেই দিল্লির সরকার জানিয়েছে, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পুরনো প্লাজমা চিকিৎসায় সাফল্য মিলছে। অর্থাৎ, করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন কিন্তু এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন এমন রোগীদের রক্ত থেকে প্লাজমা নিয়ে তা অসুস্থ রোগীর শরীরে দিলে তাঁদের শরীরেও পৌঁছে যাচ্ছে করোনার সঙ্গে লড়াইয়ের অ্যান্টিবডি। এবং তাতে লাভ হচ্ছে। বস্তুত, তাবলিগের প্রচারকদের পাশাপাশি আরও বহু সাধারণ মানুষ দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দিতে চেয়েছেন। তাঁরাও গত এক মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। 

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

শুধু তাবলিগ নয়। মানবতার এই লড়াইয়ে আরও অনেকেই যোগ দিয়েছেন। পুনেতে একটি মসজিদ কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরির জন্য ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সরকার বিবেচনা করে দেখছে সেখানে রোগীদের রাখার ব্যবস্থা করা যায় কি না। এর অনেক দিন আগেই দিল্লির বিখ্যাত মনজু কা টিলা অঞ্চলে বহু পুরনো একটি গুরুদ্বার কোয়ারান্টিন সেন্টার তৈরির জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের অন্যত্রও গুরুদ্বার ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কোয়ারান্টিন সেন্টারের জন্য। দিল্লি সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিখরা দুস্থ মানুষদের জন্য বিনামূল্যে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকে বলা হয় লঙ্গর। প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় নিরলস ভাবে সেখানে খাবার তৈরি করে তুলে দেওয়া হচ্ছে গরিব মানুষের হাতে।

মুম্বইয়ে সাঁইবাবার আশ্রম সরকারের হাতে তুলে দিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে যা ব্যবহার করা হবে। একই কাজ করেছে কোলহাপুর মন্দির। পরিসংখ্যান তথ্য বলছে, দেশের মোট অর্থের একটি বড় অংশ রয়েছে বিভিন্ন ধর্মস্থানের হাতে। সারা বছর ভক্তরা যে টাকা দান বা প্রণামী হিসেবে ধর্মস্থানে দেন। বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সেই অর্থ ব্যয় করছে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে। বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো মঠ এগিয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের সাহায্যে।

এটাই বাস্তব। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ভাবেই সমস্ত ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখনও যাঁরা, করোনার সংক্রমণ নিয়ে রাজনীতি করে চলেছেন, ধর্মীয় বিভেদ তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, বিবেকানন্দের ভাষায় তাঁরা 'ভগবানের নিকট মহা পাপ, মহা অপরাধ' করছেন। বিভেদ নয়, আমাদের ধর্ম হোক, মানবসেবার। ধন্যবাদ তাঁদের, যাঁরা স্বেচ্ছায় সেই সেবা কাজে নেমে পড়েছেন।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ৷
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷