মানুষখেকো চিতাবাঘ মোকাবিলায় উদ্যোগ
২ অক্টোবর ২০১৯মানুষের উপর চিতার হামলা
৬ বছর বয়সি ছেলেটি তার দাদি ও চাচির জিম্মায় বাসায় ছিল৷ কিন্তু ক্ষুধার্ত এক চিতাবাঘ তার পিছু নিয়েছিল৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল৷ সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন দীপা দেবী৷ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা বাইরে চুলা জ্বালিয়েছিলাম৷ আমি কড়া ও রান্নার তেল নিয়ে এসেছিলাম৷ বাচ্চাটা আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল৷ আমার শাশুড়িও সেখানে ছিলেন৷ চিতাবাঘ অন্য দিক থেকে এলো৷ দেখলাম সেটি কীভাবে বাচ্চাটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো৷ আমরা বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম৷ কয়েক সেকেন্ড পর নিজেদের সামলে নিয়ে ‘চিতাবাঘ, চিতাবাঘ' বলে চিৎকার শুরু করলাম৷ তারপর সবাই মিলে নীচে ধেয়ে গেলাম৷''
চিতাবাঘটি ছেলেটিকে মুখে নিয়ে খাদের মধ্যে চলে গেল৷ নিহত ছেলেটির চাচা পূরণ সিং সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘‘চিতাবাঘের হামলার পর ছেলেটিকে পরে প্রাণহীন অবস্থায় পাওয়া গেল৷ আমি তখন বাজারে ছিলাম৷ কয়েকজন তরুণ তার দেহ উপরে নিয়ে আসে৷ নিজের কোলে নিয়ে দেখলাম ছেলেটির দেহ অসাড় রয়েছে৷''
সেই চিতাবাঘ ৩ দিন পর একই গ্রামে প্রবেশ করেছিল৷ এবার তার লক্ষ্য ছিল ১৫ বছরের একটি কিশোর৷ নিহত ছেলেটির চাচা বলেন, ‘‘চিতাবাঘ ছেলেটিকে তাড়া করেছিল৷ ছেলেটি টের পেয়ে দৌড়াতে শুরু করে৷ বাকিদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে চিতা পালিয়ে যায়৷ দৌড়ানোর সময় ছেলেটি পড়ে যায়৷''
চিতা ধরার প্রচেষ্টা
জীবিত অবস্থায় চিতা ধরার প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে এমন খাঁচা রয়েছে৷ তবে সাধারণত অনভিজ্ঞ চিতাগুলিই সেই ফাঁদে ধরা পড়ে৷ খাঁচায় বন্দি চিতাবাঘগুলিকে পরে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ তবে মানুষখেকো চিতাবাঘ সাধারণত এমন ফাঁদে পা দেয় না৷ ৩-৪ জন নিহত হবার পর লকপট সিং রাওয়াতের মতো পেশাদারী শিকারীর ডাক পড়ে৷
রাওয়াত এখনো পর্যন্ত গুলি করে ৫৩টি মানুষখেকো বাঘ মেরেছেন৷ তার মধ্যে ৫১টি ছিল চিতাবাঘ ও ২টি সাধারণ বাঘ৷ প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক হিসেবে বাঘ সম্পর্কে তাঁর ভালই জ্ঞান রয়েছে৷ রাওয়াত মনে করেন, ‘‘চিতাবাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠলে তার আচরণ বদলে যায়৷ প্রথমত সেটি সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে মানুষের বসতিতে হানা দেয়৷ সাধারণ চিতাবাঘ রাত ১১টা নাগাদ এসে ভোর ৩টা নাগাদ চলে যায়৷ দ্বিতীয়ত মানুষখেকো মানুষকে ভয় পায় না, কারণ মানুষই তার শিকার হয়ে ওঠে৷''
চিতাবাঘ-মানুষের সংঘাত
মানুষ ও চিতার মধ্যে সংঘাত প্রায় প্রতিদিন টের পাওয়া যায়৷ এখানে প্রতি বছর চিতার হামলায় কমপক্ষে ২৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়৷ চিতাদের জন্য তার পরিণামও হয় ভয়ঙ্কর৷ গত দুই দশকে একশোরও বেশি চিতাবাঘকে মানুষখেকো ঘোষণা করা হয়েছে৷ প্রায় প্রত্যেকটিকে গুলি করে মারা হয়েছে৷ কিন্তু এর জন্য কি চিতাবাঘ দায়ী? লকপথ সিং রাওয়াত এই পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘‘পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের চিতাবাঘেরও প্রয়োজন রয়েছে৷ ভারসাম্য বজায় রাখতে তাদেরও ভূমিকা রয়েছে৷ পরিবেশগত ভারসাম্যেও তাদের অবদান রয়েছে. তাই না? এমন সুন্দর প্রাণীকে গুলি করে আমার সত্যি দুঃখ হয়৷ তাদের বাসভূমি, খাদ্যশৃঙ্খল ধ্বংস করে মানুষই এই ট্র্যাজেডি সৃষ্টি করেছে৷ আমরা জঙ্গলে প্রায় সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছি৷ তারপর ক্ষুধার তাড়নায় চিতা কোনো শিশুর উপর হামলা করলে আমরা তাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দেই৷ এটা মোটেই ন্যায্য নয়৷ আমরা ভুল করি, অথচ চিতার শাস্তি হয়৷''
পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিণাম
প্রত্যেক বছর গ্রীষ্মে হিমালয়ের কোলে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে প্রায় ৩,০০০ দাবানলের ঘটনা শনাক্ত করা হয়৷ আগুনের ফলে পাইন বনের নাজুক ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায়৷ জঙ্গলের ইতিহাসবিদ অজয় রাওয়াত এমন ঘটনার মারাত্মক পরিণতি তুলে ধরেন৷ তাঁর মতে, ‘‘জঙ্গলের ইকোসিস্টেমের প্রসঙ্গ তুললে মনে রাখতে হবে যে গাছপালার প্রয়োজন রয়েছে৷ সঙ্গে ছোট গাছ, ঝোপঝাড়, জংলি ফুল ও ফলের গাছও থাকতে হবে৷ কিন্তু সে সব উধাও হয়ে যাচ্ছে, শুধু গাছ অবশিষ্ট রয়েছে৷ মাটির উপরের স্তরের উদ্ভিদ আর আগের মতো না থাকায় ছোট প্রাণীদের লুকানো বা বাসা বাধাঁর জায়গা হারিয়ে যাচ্ছে৷ এমন ছোট প্রাণী না থাকলে প্যান্থার কী করবে? সেটি গ্রামের দিকে গিয়ে গরু, মোষ, কুকুরের মতো গৃহপালিত প্রাণী শিকার করবে৷''
এই পাহাড়েও সেই সমস্যা দেখা যাচ্ছে৷ চিতাবাঘ সম্পর্কে প্রায় সবারই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ অত্যন্ত দক্ষ শিকারি হিসেবে পরিচিত পূর্ণবয়স্ক চিতার দিনে ৫ থেকে ৬ কিলো মাংসের চাহিদা থাকে৷ চিতাবাঘ এক দিনের বেশি ক্ষুধা চেপে রাখতে পারে না৷ বাগেশ্বর জেলার বাসিন্দা রমেশ কান্ডপাল চিতাবাঘের হামলার একটি ঘটনা সম্পর্কে বলেন, ‘‘চাষের জমিতে ঘাসের মাঠ দেখে একটি গরু চরতে এসেছিল৷ সেটা ছিল সন্ধ্যার সময়৷ চিতাবাঘ গরুর উপর হামলা চালিয়ে সেটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে খেয়ে নেয়৷ এমন ঘটনা আরও ঘটবে৷ কয়েকদিন পর চিতাটি অন্য কাউকে মেরে ফেলবে৷ চিতার ভয় সবসময়ে রয়েছে৷''
রাওয়াত প্রায়ই ছাত্রছাত্রী ও নারীদের জন্য সেমিনার ও সচেতনতা কর্মসূচির আয়োজন করেন৷ তিনি চিতাবাঘ ও মানুষ – দুই পক্ষেরই সুরক্ষা চান৷
এই পাহাড়ের মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে চিতাবাঘের সঙ্গে ঘর করছে৷ কিন্তু মানুষের মনে এমন দুশ্চিন্তা এর আগে কখনো দেখা যায় নি৷ বাচ্চারা আর নিশ্চিন্তে খেলাধুলা করতে পারে না৷ সবসময়ে তাদের নজরদারি ও সুরক্ষার প্রয়োজন হয়৷
নিঃসঙ্গ চিতাবাঘেরও সুরক্ষার প্রয়োজন৷ এখনো পর্যন্ত চিতাবাঘ সংরক্ষণের কোনো পরিকল্পনা নেই৷ শুধু কত সংখ্যক চিতাবাঘ প্রতিদিন তাদের বিচরণক্ষেত্র ও জীবন হারাচ্ছে, সেই সংখ্যা জানা যায়৷
প্রতিবেদন: ওংকার সিং জনৌটি/এসবি