শুরুতেই বলে নেই মোটা দাগে জার্মানিতে বসবাসরত সংখ্যালঘুরা ভালো আছেন৷ এদেশ প্রত্যেক নাগরিককে উন্নত জীবন নিশ্চিত করেছে৷ অবস্থা এমন যে যার নিয়মিত আয় রোজগার নেই, তিনিও গাড়ি নিতে ঘুরতে পারেন৷ সমাজের সবচেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষটিও যাতে দিনের শেষে একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করতে পারেন সেই চেষ্টায় কমতি নেই সরকারের৷ আর এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির বর্ণ, ধর্ম, গোত্র আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয় না৷
আবার এটাও সত্যি যে জার্মানিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছেন খ্রিষ্টানরা৷ দেশটির মোট জনসংখ্যার ৫৭% খ্রিষ্টান, ৫% মুসলিম, ০.২% বৌদ্ধ, ০.১% ইহুদি এবং ০.১% হিন্দু৷ আর ৩৬-৩৭% অধিবাসী কোনো ধর্মের অনুসারী নয়৷ তবে, শেষে উল্লেখিত সংখ্যার একটি বড় অংশের পূর্বসূরীরা খ্রিষ্টান ছিলেন৷
জার্মানির রাষ্ট্রকাঠামোয় খ্রিষ্টান ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রয়েছে৷ এদেশের প্রত্যেক খ্রিষ্টান নাগরিক শুধুমাত্র ধর্মের অনুসারী বলে প্রতিমাসে ‘চার্চ ট্যাক্স' নামে বেতনের একটি অংশ কর হিসেবে প্রদান করেন৷ সেই অর্থ গির্জা নিয়ন্ত্রিত হাসপাতাল, স্কুলসহ নানা সামাজিক খাতে ব্যবহারের পাশাপাশি একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাটিকান সিটিতেও পাঠানো হয়৷ অর্থাৎ খ্রিস্টান ধর্মের প্রসারেও ব্যবহার করা হয় খ্রিষ্টান নাগরিকদের প্রদান করা কর, যা একজন ব্যক্তির বাৎসরিক গড় আয়ের আট শতাংশের মতো৷ আর খ্রিষ্টানদের বাইরে শুধুমাত্র ইহুদিরা এই ধরনের কর প্রদান করেন৷
সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধার্মিক সুবিধা
জার্মানিতে সব ধর্মের মানুষের ধর্মচর্চার অধিকার রয়েছে বটে তবে খ্রিষ্টানদের জন্য সেখানে এমন কিছু পাবেন যা ধর্মের বিচারে সংখ্যালঘু মুসলমানরা পান না৷ এদেশে যত সরকারি ছুটির দিন আছে সেগুলোর মধ্যে একটি বড় অংশ খ্রিষ্টান ধর্মের বিভিন্ন উপলক্ষ্য নির্ভর৷ তবে মুসলমান বা অন্য ধর্মের কোন উপলক্ষ্যে কোন সরকারি ছুটি নেই৷ এখন মুসলমানরা যদি তাদের ঈদের দিনে ছুটি নিতে চান, তাহলে সেটা তার বাৎসরিক ছুটি থেকে নিতে হবে অথবা সেদিন অন্য কোন কারণ দেখিয়ে কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে৷
ধর্মচর্চার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের ধর্মীয় রীতির চেয়ে কর্তৃপক্ষের বেধে দেয়া নিয়ম অনুসরণ করতে হয়৷ জার্মানির বন শহরে বাঙালি মালিকানার এক মসজিদের কথাই ধরুন৷ সেই মসজিদ নিয়ে সেটির আশেপাশের বাসিন্দাদের অভিযোগের শেষ নেই৷ মসজিদের কারণে সৃষ্ট শব্দদূষণে তারা নাকি ঘুমাতে পারেননা, ছুটির দিনে মসজিদে জনসমাগম তাদের বিরক্ত করেসহ নানা অভিযোগ৷ এতসব অভিযোগের কারণে গ্রীষ্মকালে সেই মসজিদে তিন ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সুযোগ থাকে, আর রবিবারসহ সব ছুটির দিনে শুধুমাত্র একঘণ্টা সেটি খোলা রাখা যায়, অর্থাৎ তখন শুধুমাত্র এক ওয়াক্ত নামাজ পড়া যায়৷
তবে মসজিদটির পেছনেই কিন্তু একটা গির্জা আছে৷ আর সেই গির্জা নিয়ে কারো কোন অভিযোগও নেই, সেখানে ধর্মচর্চারক্ষেত্রে কোন বিধিনিষেধও নেই৷
ধর্মচর্চাকারীদের তাই মানিয়ে নিতে হয়
জার্মানির ৫% মুসলমানের মধ্যে যারা ধর্ম চর্চা করতে চান, তাদের সেই চর্চারক্ষেত্র তাই অনেককিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়৷ এদেশে তারা রোজার সময় আলাদা কোন কর্মঘণ্টা পাননা, কোরবানির পশু জবাইয়ের যে ধর্মীয় বিধি সেটা মানতে পারেন না, নারীদের ধর্মীয় পোশাক পরারক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিধিনিষেধ মানতে হয় আর প্রকাশ্যে মাইকে আজান দেয়াতো পুরোপুরি নিষিদ্ধ৷ তবে শুধু মুসলমানরাই নন, সংখ্যালঘু অন্যান্য ধর্মের মানুষদেরও নানাক্ষেত্রে মানিয়ে চলার ব্যাপার রয়েছে৷ শুধুমাত্র ইহুদিদেরক্ষেত্রে বিষয়টি একটু আলাদা, তবে সেটা মূলত দেশটির নোংরা অতীতের কারণে৷
সংখ্যালঘুদের এই মানিয়ে নেয়ার পেছনে বড় কারণ দেশটিতে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে৷ জার্মানি রাষ্ট্র তার প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ৷ ফলে এখানে বসবাসরতরা মোটা দাগে নিজেদের নিরাপদ মনে করেন৷ তবে সেটা কতকাল বজায় থাকবে বলা মুশকিল৷ ২০১৭ সালে ইউরোপের দেশটিতে মসজিদ এবং মুসলমানদের উপর ৯৫০টি হামলার ঘটনা ঘটেছিল, ২০১৮ সালে সেটা কিছুটা কমে ৮১৩টি হয়েছে৷ এসব হামলার পেছনে অনেকক্ষেত্রে উগ্র ডানপন্থিদের হাত খুঁজে পাওয়া যায়৷
আগামী বছরগুলোতে যদি এরকম হামলা আরো না কমে, তাহলে সংখ্যালঘু মুসলমানরা কি আর নিজেদের নিরাপদ মনে করবেন?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷