মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি কি জাতিসংঘে গুরুত্ব পাবে?
২১ জানুয়ারি ২০২২আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত ৮ নভেম্বর জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারিকে এই চিঠি পাঠালেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার৷ তবে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এখনো তাদের এই চিঠির কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব দেয়া হয়নি৷
শান্তিরক্ষা মিশনে র্যাবকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, জাতিসংঘের ২০১২ সালের ‘পলিসি অন হিউম্যান রাইটস স্ক্রিনিং অব ইউনাটেড ন্যাশন পারসোনেল' বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না৷
২০০৪ সালে র্যাব গঠিত হওয়ার পর থেকে ইউনিটের সদস্যদের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক গুম করার ধারাবাহিক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার পরও যেসব ব্যক্তি র্যাবের সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের জাতিসংঘ মিশনে পাঠানো হচ্ছে৷
চিঠিতে আরো বলা হয়, ২০২১ সালের মার্চে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট উল্লেখ করেছেন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ানের দ্বারা নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ তৈরি করেছে৷
বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে শীর্ষ সেনা ও পুলিশ মোতায়েনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়৷ ২০২০ সালে বাংলাদেশ বিভিন্ন মিশনে ছয় হাজার ৭৩১ জন ইউনিফর্মধারী কর্মী মোতায়েন করে সর্বোচ্চ অবদান রাখে৷
জবাব দেয়ার প্রস্তুতি
বাংলাদেশ অবশ্য এই চিঠি প্রকাশ হওয়ার আগেই এইসব অভিযোগের জবাব দিতে ১৪টি মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানকে তৎপর করেছে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ওই সব মন্ত্রণালয়কে তথ্য দেয়ার জন্য চিঠি দেয়া হয়েছে৷ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২২ সালের বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তথ্য সংগ্রহ শুরু করে৷ চিঠিতে বলা হয়েছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ওপর একটি চ্যাপ্টার আছে৷ তাতে বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কিছু অভিযোগ করা হয়েছে৷ এইসব অভিযোগের জবাব দিতে তথ্য প্রয়োজন৷ চিঠিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারটি সংযুক্ত করা হয়েছে৷
চিঠিটি স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, আইন, সংসদ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, নারী ও শিশু, সমাজ কল্যাণ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বন ও পরিবেশ, শিক্ষা, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং র্যাবের মহাপরিচালকে পাঠানো হয়েছে৷ তবে কী তথ্য এখন পর্যন্ত সংগ্রহ করা হয়েছে তা জানা যায়নি৷ তবে গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র র্যাব-পুলিশের সাত কর্মকর্তার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তা পুনর্বিবেচনার আবেদন জানিয়েছে বাংলাদেশ৷
এদিকে ১২টি মানবাধিকার সংগঠনের জাতিসংঘে আবেদনের খবর প্রকাশ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছেন, র্যাবের প্রতি সব অভিযোগ চাপিয়ে দিয়ে অবিচার করা হচ্ছে৷ তিনি বলেন, ‘‘র্যাব যারা তৈরি করেছেন, এখন তারাই র্যাবকে অপছন্দ করছেন৷ র্যাবের বিরুদ্ধে নানান ধরনের অপপ্রচার করছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘র্যাব যে অনেক ভালো কাজ করেছে সেই সব কাজের কথা তারা বলছে না৷ তারা নানান ধরনের মানবাধিকারের কথা বলে৷ আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এমন কোনো দেশ নাই যেখানে এনকাউন্টার বা এই ধরনের ঘটনা না ঘটে৷ পুলিশ বাহিনীর সামনে কেউ যদি অস্ত্র তুলে কথা বলে, পুলিশ বাহিনী তো তখন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে না৷ তখনই এই সমস্যা ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটে৷''
তার কথা, ‘‘এই সবই যদি এলিট ফোর্স, র্যাবের ঘাড়ে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমি মনে করি, তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে৷''
‘সতর্কভাবে এগোতে হবে'
সাবেক কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অব.) শহীদুল হক বলেন, ‘‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং এই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর আবেদনের মধ্যে যোগসূত্র আছে৷ মার্কিন নীতি জাতিসংঘকেও প্রভাবিত করতে পারে৷ তাই বাংলাদেশকে এখন অনেক সতর্কভাবে এগোতে হবে৷ বাংলাদেশের উচিত হবে আপত্তির জায়গাগুলো ভালেভাবে দেখা এবং যদি কোনো সত্যতা থাকে তাহলে সেগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমার জানামতে র্যাব থেকে সরাসরি তাদের কোনো সদস্যকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে পাঠানো হয়৷ এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে সদস্যরা কাজ করেন তাদের মাতৃবিভাগ থেকে পাঠানো হয়৷ তাই প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার আবেদনটি ঠিক যায় না৷ তবে বিষয়গুলোকে হালকাভাবে না নিয়ে বাংলাদেশের সিরিয়াসলি নেয়া উচিত৷''
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খানও একই ধরনের মন্তব্য করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি মনে করি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এই আবেদন ব্যক্তির ক্ষেত্রে, প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নয়৷ তবে সরকারে উচিত হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা সঠিকভাবে তদন্ত করা৷ অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা৷ প্রয়োজনে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা৷ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে অভিযোগের জবাব ভালোভাবেই দেয়া যায়৷''
তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘‘মানবাধিকার সংগঠনগুলো সবদেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেও বড় বড় দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তারা নিষেধাজ্ঞার আবেদন জানায় না৷''
‘নেপথ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি'
মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং মানবাধিকার সংগঠনের র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার আবেদনের নেপথ্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আছে বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ৷ তার মতে, বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক বন্ধুদের সহায়তায় সেই রাজনীতি মোকাবেলা করা৷ আর কোনো অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘পারমাণবিক বোমার যেমন মালিক আছে এই মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও মালিক আছে৷ তারা মালিকদের ইচ্ছায় কাজ করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে জঙ্গি দমন, সন্ত্রাস দমন ও মাদক নিয়ন্ত্রণে র্যাবের অনেক বড় ভূমিকা আছে৷ হলি আর্টিজান হামলার পর তার জঙ্গি দমনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে৷ ঠিক তখনই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাবের কার্যক্রম বন্ধের দাবি তোলে৷ আবার এরাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়৷ তাদের মানবাধিকার একেক জায়গায় একেক রকম৷''
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি একাধিক সূত্র জানায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ ১২টি মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগ ও দাবির ব্যাপারে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি৷ আর জাতিসংঘ শান্তিমিশনে নেয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘেরই নিজস্ব স্ক্রিনিং সিস্টেম আছে৷ তারা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যাকগ্রাউন্ড ও ট্র্যাক রেকর্ড তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে চেক করে৷