'মাননীয়া'কে কবি পুরস্কার 'মাননীয়া'র সরকারের
১০ মে ২০২২পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর লেখা বইয়ের সংখ্যা কম নয়। দুই বছর আগেই তিনি বই লেখার ক্ষেত্রে সেঞ্চুরি পার করে গেছেন। আর দুই বছর আগেই বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল তার বিশাল কবিতার বই 'কবিতা বিতান'। মোট ৯৪৬টি কবিতা আছে সেখানে। এছাড়াও 'পছন্দের কবিতা' সহ বেশ কিছু বাংলা কবিতার বই এবং উর্দু শায়েরির বইও লিখেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীকে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমির রিট্রিভার্সিপ পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করার সময় রাাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, 'নিরলস কবিতার সাধনা' করার জন্য এবং 'কবিতা বিতান' বইয়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই পুরস্কার দেয়া হলো। যিনি এত কবিতা লিখেছেন, তিনি কবিতার নিরলস সাধনা করতেই পারেন। মুখ্যমন্ত্রীর লেখা 'এপাং ওপাং ঝপাং' ও 'হাম্বা'র মতো কবিতা বা ছড়া বহুচর্চিত। বাঙালিদের সম্পর্কে দুর্নাম আছে, তারা যৌবনে অন্তত একবার প্রেমে পড়ে এবং গোটাকয়েক কবিতা অন্তত লেখে। অনেকে তার থেকেও বেশি লিখে কবিতার সাধনা করেন। তাদের বই বেরোতে পারে, তিনি পুরস্কারও পেতেই পারেন।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে যে রিট্রিভার্সিপ পুরস্কার দেয়া হলো, সেটা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি। তারা রাজ্য সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান। রাজ্য সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের একটি অঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রীকে তারা পুরস্কার দিল। তার অর্থ কী হলো? রাজ্য সরকারই তার প্রধানকে কবিতা লেখার জন্য পুরস্কৃত করলো। অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীই নিজেকে পুরস্কৃত করলেন। সেজন্য একটি নতুন পুরস্কার পর্যন্ত চালু করা হলো। ঘটনাটা আর যাই হোক, শোভন নয়। দলনেত্রী এবং দল ও সরকারের সর্বেসর্বাকে তুষ্ট করার জন্য মন্ত্রীদের ইঁদুর দৌড় থাকতেই পারে, তবে তা এরকম স্তাবকতার পর্যায়ে গেলে বড় দৃষ্টিকটূ লাগে।
তামিলনাড়ুর সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন তার দলের সব সাংসদ, বিধায়ক, নেতাকে বুকপকেটে তার ছবি নিয়ে ঘুরতে হত। স্বচ্ছ্ব জামার পকেটে যে জয়ললিতার ছবি রাাখা আছে, সেটাও নিশ্চিত করতেন নেতারা। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি সেই পর্যায়ে হয়ত যায়নি এখনো। কিন্তু ভয় হয়। সিঁদুরে মেঘ দেখলে ঘরপোড়া গরুদের ভয় হওয়া স্বাভাবিক।
ব্রাত্য বসু জানিয়েছেন, শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের সম্মতিতে মুখ্যমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেয়া হয়েছে। কারা এই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তা ব্রাত্য বলেননি। বললে আমাদের বুঝে নিতে একটু সুবিধা হত। বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মোহ এখন ভেহে চুরমার হয়েছে। বাম আমলে তারা সকলেই প্রায় বামপন্থি ছিলেন। আবার তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর তারা সকলেই দিদিপন্থি। তাদের এই ক্ষমতাপন্থি আচরণ দেখে আমরা লজ্জা পেলেও, তাদের কোনো বিকার নেই। কিছু ব্যতিক্রম আছে, থাকবেও। ব্যতিক্রমই তো নিয়মকে প্রতিষ্ঠা দেয়। যে সেরা সাহিত্যিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে এই পুরস্কার দেয়ার ক্ষেত্রে সম্মতি দিলেন, যারা ওই অনুষ্ঠানে থেকে পুরস্কার ঘোষণা ও দেয়ার সময় হাততালিতে হল ভরিয়ে দিলেন(মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য নিজে পুরষ্কার নেননি, তার হয়ে ব্রাত্য বসুই নিয়েছেন), সেই সব সাহিত্যিকরা কি নিজের দিকে একটু তাকাবেন? নিজের বিবেকের দিকে? নাকি, ওই ক্ষমতা, সরকারি সম্মানটাই সব। তার জন্য সবকিছু মানিয়ে নেয়া যায়, নিতে হয়? একবারও তারা ভাববেন না, এই ঘটনা কতটা শোভন হবে? যাদের লেখা পড়তে আমরা ভালোবাসি, তারা কেন এমন কাজ করবেন, যা দেখে মনে হবে, ছিঃ, তারা এতটা নীচে নামতে পারেন!
সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও লিখতেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীও কবি ছিলেন। বহুবার তার মুখে নিজের কবিতা পাঠ শুনেছি। রাজনীতিকদের মধ্যে সাহিত্য প্রতিভার অভাব নেই। নিজেদের সরকারের সংগঠন যদি তাদের এরকম পুরস্কার দিত, তাহলে তো বাংলার বুদ্ধিজীবীরা সিংহগর্জন করে উঠতেন, যেন প্রলরকাণ্ড হয়ে গেছে। কিন্তু যেখানে ঘরের মামলা, সেখানে তারা রা কাড়েন না। দয়া করে এই দ্বিচারিতা বন্ধ করুন। যখন বিশপ লেফ্রয় রোডের নাম বদল করে সত্যজিৎ রায় ধরণী রাখা হলো, তখনো কেউ একবারের জন্যও বললেন না, রাস্তার নাম হলে সেটা ধরণী নয়, সরণি হবে।
মন্ত্রী, দলের নেতারা তো স্তাবকতার দৌড়ে উসেইন বোল্টের মতো ফর্মে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তাই বলে পশ্চিমবঙ্গের সেরা সাহিত্যিকরা একবারও ভাববেন না যে, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ থেকে শুরু করে শঙ্খ, সুনীল, শক্তি, নীরেন্দ্রনাথ, অলকরঞ্জন, তারাপদ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে কবিতা ও কবির একটা বহমান ধারা রয়েছে। বাংলা কবিতার মান এখনো বিশ্বের অন্য যে কোনো ভাষার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এখনো বাঙালি তরুণ থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত মানুষের একটা বড় অংশের কাছে কবিতা বড় প্রিয় বিষয়, ভলোলাগার বিষয়, ভালোবাসার বিষয়। সেই কবিতার কথা, কবিতার মানের কথাও একবারের জন্য ভাববেন না তারা!