মাওবাদী সন্দেহে বিদ্বজ্জন আটক, দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া
২৯ আগস্ট ২০১৮পুলিশের ধরপাকড়ের পর এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে বিজেপি সরকারের নিন্দা করা হয়েছে৷ এই পরিস্থিতিকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে অভিহিত করেছেন লেখিকা অরুন্ধতী রায়৷
মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার অভিযোগ তুলে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে ইউপিএর (আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট) ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে৷ আইনের এই ধারায় মামলা দায়ের করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সমাজকর্মী ও মানবতাবাদী সংস্থাগুলি৷ কারণ, এই ধারা সাধারণত প্রয়োগ করা হয় সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে৷ কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রবিরোধী মনে করলে সেইসব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের যে-কোনো সদস্যকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ৷ এদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ আছে বলে পুনে পুলিশের দাবি৷
সমাজ কর্মী ও মানবতাবাদীকে গ্রেপ্তার করাকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানান রোমিলা থাপারসহ চারজন৷ কিন্তু শী্র্ষ আদালত এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ দিতে অস্বীকার করে৷ পাশাপাশি, সুপ্রিম কোর্ট এটাও বলে যে, গণতন্ত্রে বিরুদ্ধমত হলো প্রেশার কুকারের সেফটি ভালভের মতো, যেটা না থাকলে প্রেশার কুকার ফেটে যাবে৷ বামপন্থি দলগুলি দিল্লিতে এক প্রতিবাদ সভা ডেকেছে৷ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এই ধরনের গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে মহারাষ্ট্র পুলিশকে চিঠিও দিয়েছে৷
এই প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘এই ধরনের অভিযান যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা মুশকিল৷ তবে ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনা যে সরকারের ওপর যথেষ্ট আঘাত হেনেছে, সেটা প্রমাণিত৷ উপজাতিদের মাওবাদী তকমা দিয়ে সরকার যে তাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে, আপাতত সেটাই মনে হচ্ছে৷ আগামী নির্বাচনের আগে এইসব দলিত আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন যদি একজোট হয়, তাহলে সরকার বিপদে পড়বে ভেবেই এই কৌশল নিয়েছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘তাঁদের মাওবাদী প্রতিপন্ন করতে পারলে তাঁদের মুখবন্ধ করা সহজ হবে৷ এটা পরিষ্কার৷ ১৯৭৫ সালে যেভাবে পর পর হামলা হতো, পর পর গ্রেপ্তার করা হতো, এটাকে সম্ভবত তারই একটা সূচনা-পর্ব মনে করা যেতে পারে৷ এরপর বিরোধী নেতারাও যে আক্রান্ত হবেন না, তার নিশ্চয়তা নেই৷ বলা যায়, জরুরিকালীন অবস্থা৷ মোদী সরকার চাইছেন হিন্দু ভোটের মেরুকরণ৷ সেটা হচ্ছে না৷ সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত মানুষ মেনে নিতে পারছে না৷ সরকার জোর করে চাপানোর চেষ্টা করলে আমজনতা থেকে সরকার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে৷''
বিদ্বজ্জনদের গ্রেপ্তারের উপর সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ না দেওয়া প্রসঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির জেনারেল সেক্রেটারি ধীরাজ সেনগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘ভারতে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের মান নিম্নমুখী হচ্ছে৷ এজন্য ভারতকে বিশ্বের কাছে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়৷ নিবর্তন আটক আইন দেশে আছে৷ কিন্তু সরকার বিরোধীদের ভোগাতে সেই আইনের সুযোগ নিচ্ছে৷ বিরোধীদের আটক করা যাবে৷ কয়েক বছর জেল খাটার পর দেখা গেল পুলিশ তাঁর অপরাধ প্রমাণ করতে পারল না৷ সে ছাড়া পেয়ে গেল৷ কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলো৷ তাঁকে আটক রাখা গেল৷ ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনার কি উপযুক্ত তদন্ত হয়েছিল ? মনে হয় না৷''
কিন্তু বিদ্বজ্জনদের বিরুদ্ধে কেন এই ধারা? এই বছরের জানুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রের পুনের কাছে ভীমা কোরেগাঁও-এ দলিত ও উচ্চবর্ণের মারাঠি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় রকম সংঘর্ষ হয় দলিতদের বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে৷ সেই ঘটনার পেছনে মাওবাদীদের হাত ছিল বলে মহারাষ্ট্র পুলিশের অভিযোগ৷ তদন্তে নেমে পুলিশ দেশের বিভিন্ন শহরে ধরপাকড় শুরু করে৷ গ্রেপ্তার করে অরুণ ফেরেরা, তারাভারা রাও, গৌতম নওলাখা, বার্মন গনঞ্জালভেস, সুধা ভরদ্বাজের মতো কবি, লেখক এবং আইনজীবীকে৷ তাঁরা নাকি মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দলিত ও উচ্চবর্ণ মারাঠি হিন্দুদের গন্ডগোলে উসকানি দিয়েছিলেন৷ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে দমননীতির অভিযোগ তুলেছেন অনেকেই৷
বুকার পুরস্কার পাওয়া বিশিষ্ট লেখিকা অরুন্ধতী রায় ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘এটা যেন অঘোষিত জরুরিকালীন অবস্থা৷ বিদ্বজ্জনদের বাড়িতে বাড়িতে হানা দেওয়া হচ্ছে৷ জেলে পোরা হচ্ছে৷ এটা দেশের গণতন্ত্র এবং সংবিধানের মূলে কুঠারাঘাত করা৷ এই ধরনের পরিকল্পিক অভিযান এবং জনগণের দৃষ্টি অন্য পথে চালিত করার নাটক চলবে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত৷ ওদের উচিত গো-হত্যার নামে যাঁরা গণপিটুনি দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যা করছে, হত্যায় উসকানি দিচ্ছে, তাঁদের জেলে পোরা৷'' বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ মনে করেন, ‘‘ফ্যাসিবাদ ফণা তুলছে৷ সরকারের বিরদ্ধে মানবাধিকার নিয়ে কথা বললেই তাঁকে ধরা হবে৷ বিরুদ্ধ মতবাদ বর্তমান মোদী সরকারের কাছে অসহ্য৷ এটা জরুরি অবস্থা ছাড়া আর কী?''
তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ সংগঠনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভয়-ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকারের উচিত হবে স্বাধীন মত প্রকাশের, সভাসমিতি আয়োজনের এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার সুযোগ দেয়া৷
সরব হয়েছেন রাজনৈতিক নেতারাও৷ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইটারে তোপ দেগেছেন৷ তাঁর মতে, দেশে একটাই এনজিও চলছে, সেটা হল রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ৷ বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়াবতী বলেছেন, ‘‘ক্ষমতার অপব্যবহার করছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ দলিতদের হয়ে সরকরের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এটা চলতে দেওয়া যায় না কোনোমতেই৷''