1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

'মাইয়ারে তুই অপরাধী'

সামীউর রহমান
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবি দাউদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ''৷ বাংলাদেশে, বা পৃথিবীর অনেক প্রবল পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারী হিসেবে যারা জন্ম নেন, তাদের অনেকেই হয়তো পুরুষের ইচ্ছের কাছে নিজের সিদ্ধান্ত বলি দেয়াকে নিয়তি হিসেবে মেনে নেন।

https://p.dw.com/p/4WgTd
Bangladesch | Kappenfabrik in Dhaka
ছবি: Shamsul Haque Ripon

ভালোবাসার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া, সম্পর্কের সামাজিক স্বীকৃতি চাওয়া, শারীরিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করা, এমনকি চাকরি করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটাও পুরুষতন্ত্রের অন্ধচর্চাকারীর কাছে পাপ বা অপরাধ। আর এই অপরাধ নির্ণয়ে বিচারক থেকে শুরু করে শাস্তিদাতাও সেই পুরুষ। এই ২০২৩ সালে এসেও এমন প্রবল পুরুষতান্ত্রিক ধারণা প্রচলিত থাকতে পারে গ্রামীণ সমাজে, যেখানে সভ্যতার আলো পুরোপুরি পৌঁছায়নি। কিন্তু দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো এবং ক্রিকেটের মতো ‘ভদ্রলোকের খেলা' হিসেবে গণ্য ক্রীড়াকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছেন, তারাই যদি এমন মধ্যযুগীয় ধারণা পোষণ এবং চর্চা করেন, সেটা রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতোই।

তানজিম হাসান সাকিব নামের ২১ বছর বয়সী এক ক্রিকেটার সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে তার প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছেন। অভিষেক ম্যাচেই তানজিম ভারতের অধিনায়ক এবং সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মাকে শুন্য রানে আউট করেছেন। পরবর্তীতে নিয়েছেন তিলক ভার্মার উইকেটও, যাকে সাকিব অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালেও আউট করেছিলেন; যখন তারা বয়সভিত্তিক খেলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। বাংলাদেশে বা বিশ্বের অন্য যে কোন জায়গায়, কোন ক্রীড়াবিদ যখন আবির্ভাবেই এমন কৃতিত্ব দেখান তখন তার উঠে আসার গল্প, তার খেলোয়াড় হিসেবে প্রস্তুতি পর্বে কারা কারা সহযোগিতা করেছেন; এসব বিষয়গুলোই আলোচনায় উঠে আসা। তানজিম সাকিবের বেলায় যেটা হল, তার ২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ফেসবুকের টাইমলাইনে পোস্ট করা কিছু মন্তব্যের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে গেল। একজন ধর্মীয় বক্তার উক্তি হিসেবে সাকিব যে মন্তব্যগুলো ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন, তার অংশ বিশেষ হচ্ছে, ' স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।' এরপর আরো অনেক বাক্য আছে কর্মজীবি নারীদের সম্পর্কে, যার মোদ্দা কথা হচ্ছে নারীকে ঘরেই থাকতে হবে, তাহলেই সমাজ পাপাচার মুক্ত থাকবে। প্রথমত সাকিব যে কথাগুলো ফেসবুকে

লিখেছিলেন, সেসব একজন ধর্মীয় বক্তার নিজস্ব বক্তব্য। কোন ধর্মগ্রন্থের আলোকে; কোরআন, হাদীস, বা সুন্নাহ'র ভিত্তিতে সেই বক্তা এই কথাগুলো বলেননি কারণ সেটা প্রতিষ্ঠা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ইসলাম ধর্মের শেষ প্রেরিত পুরুষ হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে নবুওত প্রাপ্তির পূর্বে হজরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদের অধীনে চাকরি করেছেন। খাদিজা ছিলেন সেসময় মক্কার একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যবসায়ী, তার পন্যবাহী উটের কাফেলা সিরিয়া এবং ইয়েমেন পর্যন্ত যেত। মুহাম্মদ (সাঃ) এর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রঃ) নিজে উটের পিঠে চেপে যুদ্ধ করেছেন। তাই বলা যায়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সাকিবের এই বক্তব্য মেনে নেবার কোন স্থান নেই। সাকিব হয়তো ঐ বক্তার ব্যক্তিগত মতের সঙ্গে একমত পোষণ করে থাকতে পারেন। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, দেশে ধর্মীয় বক্তব্যের নামে কিভাবে এবং কতটা নারী বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে যার সঙ্গে ধর্মের প্রকৃত অর্থে কোন সম্পর্ক নেই এবং এর মাধ্যমে কিভাবে সমাজের একটা বড় অংশ প্রভাবিত হচ্ছে।

সাকিব ২০২০ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ-১৯ জাতীয় দলের হয়ে খেলে দক্ষিণ আফ্রিকায় হয়ে যাওয়া যুব বিশ্বকাপ জিতেছেন। এরপর থেকে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড পরিচালিত হাই পারফরম্যান্স স্কোয়াড এবং অন্যান্য ছায়া দলেরও অংশ ছিলেন সাকিব। এসব দলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে তিনি নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। সাকিবের এমন মনোভাব থেকে একটা ব্যপার স্পষ্ট, বিসিবি একজন তরুণ উদীয়মানকে দক্ষ ক্রীড়াবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে যতটা মনোযোগী, তাকে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ততটাই উদাসীন। একজন ক্রিকেটার, যাকে জাতীয় দলের জন্য সম্ভাবনাময় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, তার সামাজিক আচরণ নিরুপণে বিসিবি কোন পদক্ষেপ নেয় না। একজন ক্রিকেটার গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেমন আচরণ করবেন তার কোন নির্দেশনা থাকলে সাকিব নিশ্চয়ই এমন বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখতে পারতেন না।

মজার বিষয় হচ্ছে, বিসিবির যে আচরণ বিধি আছে সেটা লঙ্ঘন হয় কেবল ক্রিকেট বোর্ডের বা কর্তাদের সমালোচনা করলে। ক্রিকেটার সাইফউদ্দিন তার চিকিৎসা চলাকালীন কেউ খোঁজ নেয়নি, এসব গণমাধ্যমে বললে তাকে ডেকে নিয়ে সতর্ক করা হয়। টি-টোয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়ার পর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানানোর ফলে মুশফিকুর রহিমের মত ক্রিকেটারকেও বিসিবি কার্যালয়ে ডেকে এনে সতর্ক করেন প্রধান নির্বাহী ও প্রধান নির্বাচক। অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে জেল খেটে আসা ক্রিকেটারেরও পাশে থেকেছে বিসিবি।

বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহান নিত্য মিলে তাদের বাসার ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মীকে নিপীড়ন ও মারধোর করেন। এই ঘটনায় মামলা হয়, পরবর্তীতে মেয়ের পরিবার অর্থের বিনিময়ে আপোষে এসে মামলা তুলে নিলে বেকসুর খালাস পেয়ে যান দুজনে। আরেক পেসার রুবেল হোসেন এক সময়ের মডেল ও অভিনেত্রী নাজনীন আক্তার হ্যাপির করা ধর্ষণ মামলায় জেলে গিয়েছিলেন। পরে অভিযোগ থেকে খালাস পান রুবেল। সেসময় রুবেল ও হ্যাপির একটি কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হয়েছিল। এর কয়েক শব্দ পরে রুবেলকে  একটি মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে বলতে শোনা যায়। রুবেল যেখানে বাস্তব জীবনে মেয়েটিকে হুমকি দিয়েছিলেন, সেই শব্দগুলোকে বিজ্ঞাপনে তুলে আনার মত অশ্লীল উদযাপনও দেখা গেছে বাংলাদেশে। নিয়ম অনুযায়ী, ক্রিকেটাররা বিজ্ঞাপনে অংশ নিলে স্ক্রিপ্ট দেখিয়ে বিসিবির অনুমোদন নিতে হয়। তাহলে ধরেই নেয়া যায়, এই ব্যপারে মত ছিল বিসিবিরও।

একাধিক বিয়ে, যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে মারধোর এসব ক্রিকেটারদের নৈমিত্তিক বিষয়। ফেসবুকে অন্তরঙ্গ ছবি মাঠিয়ে সেসব ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান এবং ২০ লাখ টাকা যৌতুকের দাবিতে আরাফাত সানির বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ও যৌতুক আইনে দুটি মামলা করেন তার স্ত্রী পরিচয় দেয়া নাসরিন সুলতানা। মামলার পর পুলিশ তাকে রিমান্ডেও নেয়।এই ঘটনা ২০১৭ সালের। পরবর্তীতে বাদী আদালতে উপস্থিত হয়ে জানান যে তিনি সানির সঙ্গে ঘরসংসার করছেন, পরবর্তীতে এই ক্রিকেটারকে অব্যহতি দেয়া হয়।

যৌতুক ও নারী নির্যাতন মামলার আসামী হয়েছেন মোসাদ্দেক হোসেনও। বয়স লুকিয়ে, অনূর্ধ ১৯ বিশ্বকাপে খেলতে যাবার আগে আপন খালাত বোন সামিয়া শারমিনকে বিয়ে করেছিলেন মোসাদ্দেক, কাবিন নামায় লেখা হয়েছিল পাত্রের বয়স ২২! পরবর্তীতে স্ত্রীকে নির্যাতন করেন মোসাদ্দেক, কনেপক্ষের দাবি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক আছে মোসাদ্দেকের। বিষয়টি আদালতে গড়ালেও শেষ পর্যন্ত বাদীপক্ষ মামলা চালিয়ে যাননি, কারণ জাতীয় দলের ক্রিকেটার মোসাদ্দেকের সামাজিক প্রভাব। এই ঘটনা ২০১৮ সালের, এরপরও জাতীয় দলে নিয়মিত খেলেছেন মোসাদ্দেক। বিসিবির সবশেষ কেন্দ্রীয় চুক্তিতেও মোসাদ্দেক আছেন টি-২০ দলের অংশ হিসেবে, যদিও এই বছর তিনি কোন সংস্করণেই জাতীয় দলে খেলেননি। যৌতুক ও নির্যাতনের মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে পেসার আল আমিন হোসেনের বিরুদ্ধেও। তার স্ত্রী বিসিবি কার্যালয়ে চিঠি দিয়েছেন, অবস্থান ধর্মঘটও করেছিলেন মিরপুরে স্টেডিয়ামের সামনে।

২০২০ সালে, নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ফেসবুকে একযোগে ভিডিওবার্তা প্রকাশ করেছিলেন সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মমিনুল হক ও সৌম্য সরকার। মজার বিষয় হচ্ছে, তারা নিজেরাই নারী নির্যাতকদের কাছে টেনে নেনে সতীর্থ হিসেবে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে তোলেন স্লোগান! রুবেল হোসেন সবশেষ মৌসুমেও মাশরাফির সঙ্গে একই দলে খেলেছেন বিপিএলে, সিলেট স্ট্রাইকার্সে। মোসাদ্দেকের সঙ্গে তো অনেকেই খেলেছেন জাতীয় দলেও!

নারী নির্যাতন বা সহিংস আচরণের জন্য বিসিবি কোন ক্রিকেটারকে নিষিদ্ধ করেছে এমন নজীর নেই। ধর্ষণের অভিযোগে জেল খেটেছেন, বিদেশি বিমান 'বোর্ডিং ডিনাই' করেছে এমন ক্রিকেটারও দিব্যি খেলেছেন জাতীয় দলে। তাদের উত্তরসূরী তাই ফেসবুকে নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করলে 'কিই বা আর হবে' এমন মনোভাব পোষণ করতেই পারেন।

লায়লা আরিফা খানম একটি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত। তিনি মনে করেন, সমাজের সার্বিক যে পরিস্থিতি, ক্রীড়াঙ্গণ তার বাইরে নয়। ডয়চে ভেলেকে লায়লা জানান, 'আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে সর্বস্তরে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের চর্চা প্রকটভাবে প্রচলিত সেখানে ক্রীড়াবিদদের বিষয়ে আলাদা বলবার কিছু নেই। তবে যেহেতু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন এর প্রায় সর্বত্রই যেমন খেলোয়াড় থেকে শুরু করে প্রশিক্ষক,নির্বাচক,প্রশাসন এখনো পর্যন্ত ছেলেদের দখলে সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব এর প্রতিফলন বেশিমাত্রায় লক্ষনীয়। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে পুরুষদের বৃহত্তর অবস্থান ও চিন্তার বৈচিত্রহীনতা, জেন্ডারবিষয়ক ধারণার অভাব এবং জেন্ডারলেন্সের প্রয়োগহীনতা দায়ী' জানিয়েছেন নারী মৈত্রীর প্রকল্প সমন্বয়ক লায়লা।

ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি যে কোন রকম বৈষম্যের বিরোধী এবং এই ব্যপারে আইসিসির সদস্য দেশগুলোও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ১৪ অক্টোবর ২০২২ সালে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে একসঙ্গে কাজকরার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে আইসিসি এবং ইউনিসেফ। তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানের মেয়েদের ক্রিকেট দলকে খেলতে না দেয়ার বিষয়টি আইসিসি পর্যবেক্ষণ করছে। নারীদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ না দেয়ার প্রতিবাদে আফগানিস্তান ক্রিকেট দলকে অস্ট্রেলিয়াতে আমন্তণ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। অতীতে বর্ণবাদী মন্তব্য করে টুইট করায় টেস্ট অভিষেকের পর নিষিদ্ধ হতে হয় ইংল্যান্ডের পেসার অলি রবিনসনকে। এক মহিলাকে অশ্লীল টেক্সট মেসেজ ও ছবি পাঠানোর দায়ে টেস্ট দলের নেতৃত্ব হারিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার টিম পেইন। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে অনেক ক্রিকেটার এর চেয়ে গুরুতর অপরাধ করেও দিব্যি খেলে যাচ্ছেন।

২০১৮ সালের ঘটনা। ফেসবুকে বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের ড্রেসিংরুমে বসে গান গাওয়ার একটি ভিডিও অন্তর্জালে ভাইরাল। সাকিব, লিটন সহ অনেকেই ড্রেসিং রুমে পানির বোতল আর হাতের কাছে পাওয়া নানান রকম জিনিষপত্র বাজিয়ে কোরাসে গাইছেন, ' মাইয়া রে মাইয়ারে তুই অপরাধী রে'। চটুল সুরে, রীতিমত কদর্য কথার সেই গান তাদের ঠোঁটস্থ। যে গানের কথার মূল বিষয় হচ্ছে, প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়া মেয়েটি অপরাধী। যেন কোন মেয়ের নিজস্ব পছন্দের অধিকার নেই, কোন পুরুষ প্রেমের প্রস্তাব দিলে রাজি না হওয়াটা কিংবা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসাটা গর্হিত অপরাধ। এতেই বোঝা যায় তানজিম সাকিব একা নন, অনেকেই নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ধারণা পোষণ করেন। হয়তো কেউ সেটা ফেসবুকে প্রকাশ করেন না তবে আচরণে সহিংসও হন।

জাতীয় দলের মত শীর্ষ পর্যায়ে যারা ক্রিকেট খেলেন, তাদের মনোজগতে এবং প্রকাশভঙ্গীতে পরিবর্তন আনাটাই পরিত্রাণের উপায়, মনে করেন জেন্ডার স্পেশালিস্ট এস এম ফরিদুল হক। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত ফরিদুল ডয়েচে ভেলেকে বলেছেন, 'খেলোয়াড়েরা যেহেতু সমাজের, বিশেষত তরুণদের রোল মডেল কাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সচেতন হওয়া উচিত। তাদের চিন্তা ভাবনা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক কর্মকাণ্ড অন্যদের প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে তাই তাদের খেলাধূলা বিষয়ক সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি একজন সংবেদনশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠার উপরও জোর দিতে হবে। নইলে সাধারণ মানুষ কিন্তু নেতিবাচকতা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে না, তারা মনে করবে আমাদের "হিরোরা” যেহেতু মেয়েদেরকে এভাবে দেখে কাজেই এটাই হয়তো ঠিক। যেমন ধরেন একজন ক্রিকেটার নারীবিদ্বেষি পোস্ট দিল ফেইসবুকে, এর মধ্য দিয়ে সে যে খালি নারীর প্রতি নিজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করল তাই না, বরং আরো কিছু মানুষের মধ্যে এই নেতিবাচকতা ছড়িয়ে দিল। আবার আমাদের খেলোয়াড়দের কেউ কেউ নানা সময়ে নারী নির্যাতনের মত ঘটনা ঘটিয়েছেন, কেউ স্ত্রীকে কেউ গৃহকর্মীকে প্রহার করেছেন। এইসব ঘটনা কিন্তু স্পষ্টতই আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে আমাদের রোল মডেলদের মধ্যে মূল্যবোধের, সংবেদনশীলতার অভাব আছে। অথচ আমরা একটু সচেতন হলে তাদের ইমেজকে সমাজ পরিবর্তনে ব্যবহার করতে পারতাম।

সামিউর রহমান
সামিউর রহমান, সাংবাদিকছবি: Mir Farid

সংশ্লিষ্ট বোর্ড বা জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কিন্তু চাইলেই আমাদের খেলোয়াড়দের নারীর প্রতি এই নেতিবাচক মানসিকতা এবং আচরণ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শুধু তাদের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীলতা বিষয়ক , সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার বিষয়ক কিছু সেশন আয়োজন করতে পারে, যেখানে তারা নিজেদের মন মানসিকতা ও আচরণ নিয়ে কাজ করতে পারবে। একজন মানুষ হিসেবে, খেলোয়াড় হিসেবে, সমাজের রোল মডেল হিসেবে কি কি করা যাবে না সে বিষয়ে তারা সম্যক ধারণা পাবে।

এধরনের উদ্যোগ না নিলে কিন্তু খেলাধূলার যে অন্যতম উদ্দেশ্য, তারুণ্যের বিকাশ; ইতিবাচকতার চর্চা; মিলেমিশে লক্ষ্য অর্জনে কাজ করা; আদর্শ খেলোয়াড়কে অনুসরণ করার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তোলা এসবই কিন্তু ব্যহত হবে।'

সবশেষে বলা যায়, তানজিম সাকিবের যে পোস্টটি নিয়ে হঠাৎ করেই যে আলোচনা, যে পোস্টের জন্য সাকিব ক্ষমা চেয়েছেন এবং বয়স বিবেচনায় বিসিবিও জানিয়েছে তারা শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না; এসব কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দূর্নীতি কিংবা শৃঙ্খলাভঙ্গে বিসিবির যেমন কঠোর অবস্থান, লিঙ্গ বৈষম্য অথবা নারীর প্রতি সহিংস আচরণের বেলায় তাদের সেই অবস্থান নেই বলেই ক্রিকেটাররা নানান সময়ে এমন আচরণ করে পার পেয়ে আসছেন। এটাও যেমন সত্যি, ঠিক একই ভাবে  বলা যায়, আইসিসির বৈষম্য বিরোধী নীতির পালন এবং এই সম্পর্কে ক্রিকেটারদের সচেতন করার কোন প্রক্রিয়াও বিসিবি অনুসরণ করে না। তাই তো ক্রিকেটাররা 'মাইয়া'দের 'অপরাধী'ই ভেবে যান, সেটা প্রেমের সামাজিক স্বীকৃতির দাবি জানাবার জন্যই হোক কিংবা চাকরি করার জন্য।