‘মা স্কুল কবে খুলবে'
২১ মে ২০২১স্কুল বন্ধ থাকার কারণে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীরা; বিশেষ করে নগর ও শহরাঞ্চলের শিশুরা। গত বছর ১৭ মার্চ দেশে প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা আসে। সরকার বেশ কয়েক দফায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়ে বিবেচনা করলেও দেশে মহামারি পরিস্থিতির কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। বরং দফায় দফায় বন্ধ থাকার মেয়াদ বেড়েছে।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বন্দি এ সময়ে শিশুরা মোবাইল ও ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মোবাইল বা টিভি নিয়ে হয় তারা ঘরের এককোণে পড়ে থাকছে। আর সেগুলো না পেলে ঘরের ভেতর এতটাই দুরন্তপনা করছে যে, তাদের শান্ত রাখতে অভিভাবকরা বাধ্য হয়ে হাতে ডিভাইস তুলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন পার্ক এবং বিনোদন কেন্দ্রগুলো মহামারিতে বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা শিশুদের সেখানেও নিয়ে যেতে পারছেন না।
স্কুল একটি শিশুকে শুধু লেখাপড়াই শেখায় না, বরং তাকে সামাজিক হতেও শেখায়। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা বাড়ি থেকে বের হওয়ার বা অন্যদের সঙ্গে মেশার সুযোগ একদমই পাচ্ছে না। দিন দিন অসামাজিক হয়ে উঠছে।
আমার ছেলের আচরণেই আমি এ পরিবর্তন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ছোট বেলা থেকে সে মিশুক প্রকৃতির। স্কুলে যেতে খুবই পছন্দ করতো। অচেনা মানুষের সঙ্গেও খুব সহজ-স্বাভাবিকভাবে কথা বলতো। বিকালে বাসার সামনে ছোট্ট কানাগলিতে খেলতে যেতে তার দুর্নিবার আকর্ষন ছিল।
দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের প্রথমদিকে আতঙ্কে কিছুদিন তাকে বিকালে খেলতে যেতে দেইনি। স্কুলও বন্ধ। সারাদিন চার দেয়ালের মাঝে বন্দি। মোবাইল বা টেলিভিশন দেখে কেটেছে সময়, যা এখন রীতিমতো আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।
দেশে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে তাকে বিকালে খেলতে যেতে বললেও সে আর আগ্রহ দেখায় না। বরং মোবাইলে গেমস খেলাতেই আগ্রহ। অনলাইনে পুরো দমে ক্লাসও ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা সে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকছে, ভাবা যায়! দৈনন্দিন রুটিনের কোনো বালাই নেই।
আমি কর্মজীবি মা। দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের কিছুদিন পর থেকেই হোম অফিস করছি। তাকে যদি বলি, এত সময় মোবাইল কেন দেখছো?
উত্তরে সে বলে, তুমি কেন এত সময় ল্যাপটপে বসে আছো?
‘‘আমি তো অফিস করছি।”
‘‘তুমি তো অফিস করছো, আমি কী করবো?”
তার এই ‘আমি কী করবো' প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। ছবি আঁকো বা খেলনা নিয়ে খেলো- এসবই এখন তার কাছে বোরিং। একই প্রশ্ন, মা, কবে স্কুল খুলবে। বন্ধুদের সঙ্গে কবে দেখা হবে। অনলাইন ক্লাস করবো না, বোরিং লাগে।
দীর্ঘ সময় স্কুলের বাইরে থাকার কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই আচরণগত পরিবর্তন এসেছে বলে মত মনোবিজ্ঞানীদের। একদিকে যেমন তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনে অনভ্যস্ত হয়ে পড়ার প্রবণতাও বাড়ছে। শিশুরা একা থাকায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে স্কুল খুললে অন্য শিশুদের সঙ্গে তাদের খাপ খাওয়ানো বা ক্লাসে মনযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠবে।
শুধু মানসিক সমস্যা নয়, দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুদের শারীরিক সমস্যাও বাড়ছে। শহুরে শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। দিনের পর দিন দীর্ঘসময় ইলেক্ট্রনিক ভিভাইসের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তাদের চোখ ও মস্তিষ্কের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে।
আমার ছেলের বেলায় আরো একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ বছরের শুরু দিকে সে হঠাৎ করে বলতে শুরু করে, তার বুকে ব্যাথা করছে। প্রায় সময় বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিতো, বলতো দম আটকে আসছে। টানা কয়েকদিন এ অবস্থা দেখে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই। তিনি নানা পরীক্ষার পর কোনো সমস্যা খুঁজে পাননি।
পরে আমাদের বলেন, করোনা মহামারির মধ্যে শিশুদের এই একই সমস্যা নিয়ে অনেক অভিভাবক তার কাছে আসছেন। দীর্ঘ সময় ঘরবন্দি থাকার কারণে শিশুরা হতাশ হয়ে পড়ছে এবং তার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে এমনটা হতে পারে বলে মত তার।
এ তো গেল শহুরে শিশুদের অবস্থা। গ্রামে শিশুরা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মোবাইল, টেলিভিশন বা ইন্টারনেট না থাকায় তারা দূরশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছে না। গত বছর ব্র্যাকের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী দূরশিক্ষণের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর ইউনিসেফের এক গবেষণা জরিপে দেখা যায়, মহামারির মধ্যে বিশ্বে মোট শিক্ষার্থীর প্রতি তিনজনে একজন, অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪৬ কোটি শিশু অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় অনেক শিশুর স্কুলে ফেরাই অনিশ্চিত হয়ে গেছে। পুরো দেশে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ।
অনেকের হয়তো স্বরলিকা পারভিনের কথা মনে আছে। ২০১৭ সালে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবলে ‘হ্যাটিট্রিক কন্যা' নামে খ্যাতি পাওয়া স্বরলিকা টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার জিতেছিল। সেই স্বরলিকা মহামারির মধ্যে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। স্বরলিকা একা নয়, কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার বাঁশজানি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাত কিশোরী ফুটবলারই এখন মাঠের বদলে সামলাচ্ছে সংসার, সবাই বাল্যবিবাহের শিকার।
অনেক শিশু স্কুল না থাকায় পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে নানা কাজে যুক্ত হচ্ছে। ওই সব শিশু আর হয়ত কোনো দিনই স্কুলে ফিরতে পারবে না।
শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের চিত্রই এমন। সেভ দ্য চিলড্রেনের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহামারির কারণে বিশ্বের ৯৭ লাখ শিশুর হয়ত আর কোনোদিন ক্লাসে ফেরা হবে না।
বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর সংক্রমণের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে বেশিরভাগ দেশই প্রথম যে কাজটি করেছে, সেটি হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া।
২০২০ সালের শুরুর দিকে ইউরোপের দেশগুলোতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মাঝে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এলে স্বাস্থ্যবিধি মানার নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে স্কুল খুলে দেওয়া হয়। তারপরও দেখা যায়, সংক্রমণ বাড়ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা ভাইরাসে সংক্রমতি হচ্ছেন। ফলে দেশগুলো পুনরায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। স্কুল খোলার কারণেই সংক্রমণ বেড়েছে কিনা তার কোনো গবেষণা-ভিত্তি এখনো পাওয়া যায়নি।
ভাইরাস সংক্রমণ কমে যাওয়ায় এ বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিষয়ে তোড়জোড় শুরু করেছিল। কিন্তু মার্চে পুনরায় সংক্রমণ বাড়তে থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর খোলা হয়নি। তাতে কি সংক্রমণ বিস্তারের ঊর্ধ্বগতি থামানো গেছে?
মহামারি নিয়ন্ত্রণে এই যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা, তাতে সংক্রমণের বিস্তার হয়ত খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে, কিন্তু শিশুদের উপর দীর্ঘ মেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
অর্থনীতির চাকা সচল রাখার কথা বলে দেশে সব কিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সংক্রমণের বিস্তার আসলেই কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব? বরং স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি কমাতে বাড়িতে যারা বয়স্ক বা ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন, তাদের থেকে শিশুদের নিরাপদ দূরত্বে রাখা যেতে পারে।
কোভিড-১৯ মহামারি এখন আর তিন মাস, ছয় মাস বা এক বছরের ব্যাপার নয়। টিকা আবিষ্কারের পর এই মহামারি বিদায় নেওয়ার যে আশা করা হয়েছিল, সেটাও এখন আর খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। বরং টিকা গ্রহণের পরও অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই করোনাভাইরাস যে সহজে বিদায় নিচ্ছে না, তা মোটামুটি অনুমেয়।
জাতিসংঘও বলছে, মৌসুমি রোগ হিসেবে এটি পৃথিবীতে থেকে যেতে পারে। সেটা হলে বাংলাদেশেও অল্পবিস্তর করোনা রোগী সব সময় থাকবে। কিন্তু বছরের পর বছর তো আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সম্ভব না।
আধুনিক সভ্যতার প্রধান ভিত্তির অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এজন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াটা জরুরি।
‘মা স্কুল কবে খুলবে' সন্তানের এ প্রশ্নের মুখোমুখি আর হতে চাই না।