মশা দমনে নতুন কৌশল – বিভ্রান্তিকর গন্ধ
২৩ আগস্ট ২০১১মশারা মানুষ ও জীবজন্তুর রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে৷ অ্যানোফেলিস এবং কিউলেক্স মশা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও শ্লীপদের মতো মারাত্মক বহু অসুখের বাহকও৷ মশাদের ঘ্রাণ নেওয়ার ক্ষমতা খুব প্রখর৷ মানুষ ও জীবজন্তু নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে, তা অনুসরণ করে প্রাণীটির কাছে চলে যায় তারা এবং হুল ফুটিয়ে রক্ত পান করে৷ অ্যামেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক আনন্দ রায় মশার ঘ্রাণেন্দ্রিয় নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন৷ এই ইন্দ্রিয়টিকে দিকভ্রষ্ট করতে পারলে মশার হুল ফোটানোর হাত থেকেও রক্ষা পেতে পারে প্রাণীরা৷ মশাকে বিতাড়িত করার প্রচলিত সব পদ্ধতিই এর ঘ্রাণকে কেন্দ্র করে৷ গবেষক আনন্দ রায় এক্ষেত্রে আরো একটু গভীরে গিয়ে মশার কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোঁকার ক্ষমতাটাকে ওলটপালট করে দিতে চান৷ এব্যাপারে ১০০ ধরনের অ্যালকোহল ও অ্যাসিড নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সফল হয়েছেন তিনি৷ আনন্দ রায়ের ভাষায়, ‘‘আমরা তিন ধরনের গন্ধ খুঁজে পেয়েছি, যেগুলি কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ পাওয়ার ওপর প্রভাব রাখতে পারে৷ প্রথমটি ঘ্রাণ নেওয়ার অনুভূতিকে রুদ্ধ করে দেয়৷ মশারা আর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গন্ধ পায়না৷ দ্বিতীয়টি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাসের মত কাজ করে, পতঙ্গগুলিকে কিছুটা ফাঁকি দিয়ে মনে করায় কোথাও বুঝি খাদ্য আছে৷ আর তৃতীয়টি আমাদের বিস্মিত করেছে৷ একবারে নতুন ধরনের৷''
মশার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়কে বিভ্রান্ত করা হয়
এই তৃতীয় ধরনটি মশার কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘ্রাণ নেয়ার সংকেতকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে৷ সাধারণতঃ গন্ধ পাওয়ার সাথে সাথে সংকেতটা মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়৷ নতুন ধরনের পদার্থ ঘ্রাণের সংবেদন কোষকে উত্তেজিত করে কয়েক মিনিট ধরে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে থাকে, গন্ধ উদ্দীপক বস্তুটি কাছে না থাকলেও৷ এই ভাবে মশাদের কার্বন-ডাই-অক্সাউডের গন্ধ শোঁকার অনুভূতিকে ওলটপালট করে ফেলা যায়৷ এ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন আনন্দ রায়৷ এজন্য প্রয়োজন এক মিটার দীর্ঘ একটি নলের, যার ভেতরে দুটো ক্যামেরা দিয়ে পতঙ্গগুলিকে লক্ষ্য করা হয়৷ নলের এক প্রান্তে থাকে একটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস উত্পাদক যন্ত্র এবং একটি বায়ু উত্পাদক জেনেরেটর, অন্য দিক দিয়ে মশাগুলিকে প্রবেশ করানো হয়৷ এ প্রসঙ্গে আনন্দ রায় জানান, ‘‘এর আগে আমরা মশাগুলিকে নতুন ধরনের গন্ধের সংস্পর্শে এনেছিলাম৷ তাই তাদের মাথা গুলিয়ে যায় এবং একই বৃত্তে ঘুরতে থাকে তারা৷ কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উত্স খুঁজে পায়না৷''
অন্যদিকে নতুন ধরনের গন্ধের সংস্পর্শ ছাড়া মশাদের নলের মধ্যে ছেড়ে দিলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উত্তপত্তিস্থলে ছুটে যায় তারা৷ পার্থক্যটা বিস্ময়কর৷
নতুন কৌশলের সুফল দেখা গেছে বাস্তবেও
গবেষক আনন্দ রায় বাস্তব ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করে সুফল পেয়েছেন৷ কেনিয়ার এক গ্রামের কয়েকটি কুঁড়ে ঘরে কার্বন-ডাই-অক্সাইড উত্পাদক যন্ত্র রেখে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন তিনি, যেখানে চারপাশে ছিল মশার উপদ্রপ৷ কয়েকটি ঘরে ছাড়া হয় মশাকে বিভ্রান্ত করার গন্ধ৷ সারারাত ধরে মশাগুলি প্রবেশ করে ঘরগুলিতে৷ পরদিন দেখা গেল গন্ধহীনের চেয়ে গন্ধযুক্ত ঘরগুলিতে মাত্র অর্ধেক মশা রয়েছে৷ তবে এই পদ্ধতির মাধ্যমে মশাকে দমন করে সংক্রামক রোগ ব্যাধি দূর করা কতটা সফল হবে, তা এখনই বলা যায়না৷ কিন্তু এক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল আশাব্যঞ্জক, মনে করেন মেরিল্যান্ডের ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেল্থের' পতঙ্গ গবেষক মার্ক স্টোপ্ফার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, তাঁদের অনুমান সঠিক৷ তাঁরা এমন এক পদ্ধতি বের করেছেন, যা মশা দমনে প্রচলিত কলা কৌশলের পরিপূরক হতে পারে৷''
মশা দমনের এই গন্ধ মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিনা, সে বিষয়টি অবশ্য স্পষ্ট নয়৷ এছাড়া নতুন ধরনের মশা নিরোধক গন্ধের কোনো কোনোটি খুবই অস্বস্তিকর, যেমন পচা মাখনের মত৷ তাই আনন্দ রায় ও তাঁর সহকর্মীরা এখন এমন ধরনের গন্ধের অণু বের করার চেষ্টা করছেন, যেগুলি মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়৷
প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ