মমতা ব্যানার্জির মুখে আবার কেন অনুপ্রবেশের কথা?
৪ জানুয়ারি ২০২৫বৃহস্পতিবার কলকাতায় প্রশাসনিক বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরাবরের মতো এ বৈঠকেও রাজ্যের মন্ত্রীরা ছিলেন, পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরাও ছিলেন। বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার ও অন্য কর্মকর্তারাও বৈঠকে ছিলেন।
মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে সেখানে বলেন, মালদহে বিএসএফের সঙ্গে পুলিশ অ্যাডজাস্ট করে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী ঢোকাচ্ছে। তারপর তিনি নিজের বক্তব্য সংশোধন করে বলেন, ''পুলিশ নয়, বিএসএফ অনুপ্রবেশকারী ঢোকাচ্ছে। ইসলামপুর, সিতাই, চোপড়া দিয়ে ঢোকাচ্ছে। আর পুলিশ তাদের কিছু বলছে না। সমঝোতা করছে।''
কেন এইভাবে বিএসএফ অনুপ্রবেশকারী ঢোকাচ্ছে, তার একটা ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি বলেন, ''বাংলাকে বদনাম করার জন্য বিএসএফকে দিয়ে কেন্দ্র এই কাজ করাচ্ছে। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের ব্লু প্রিন্ট। বর্ডার দিয়ে গুণ্ডা পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওরা খুন করতে আসছে। আমার রাজ্যে জঙ্গি হানাকে মদত দিলে প্রতিবাদ করতেই হবে।’’
রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তুলেও ক্ষান্ত হননি। রাজ্যের পুলিশকে আরো বিরূপ মন্তব্য করেছেন। মালদহে তৃণমূল নেতা দুলালচন্দ্র সরকার খুনের প্রসঙ্গে তিনি আবার বলেছেন, ''এসপি-কে বলবো, এগুলো দেখুন। শুধু কালিয়াচক আর বর্ডার নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।’’
অন্য রাজ্যের পুলিশ সম্পর্কে মমতার বক্তব্য
বৈঠকে রাজ্যের মন্ত্রী উদয়ন গুহ অভিযোগ করেন, দিল্লি পুলিশ এসে পরিযায়ী শ্রমিকের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে গেছে। তা শুনে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ''দিল্লি পুলিশ কেন এসেছিল? তারা কি রাজ্য পুলিশের অনুমতি নিয়েছিল? অনুমতি ছাড়া অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ এসে এ রাজ্যে যা খুশি তাই করছে কী করে? পুলিশ সুপার কেন রাজ্য পুলিশের ডিজিকে জানাননি?''
পুলিশ সূত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছে, নিয়ম হলো অন্য রাজ্য থেকে পুলিশ এলে আগে থেকে রাজ্য পুলিশকে নিয়মমাফিক জানাতে হয়। সেই নিয়ম মেনেই পুলিশ সাধারণত কাজ করে।
মমতার বক্তব্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল তার সাপ্তাহিক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ''ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তে যাতায়াত নিয়মমাফিক হচ্ছে। যারা নিয়ম মানছেন না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যেসব নিরাপত্তারক্ষী ও সেনা সীমান্তে আছেন, তাদের কাজই হলো আইনকে রক্ষা করা।''
ভুয়া পাসপোর্ট প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ''ভারতীয় পাসপোর্ট ভারতীয় নাগরিকদের জন্যই। এর কোনো বিচ্যূতি হলে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়, ভবিষ্যতেও নেবে।’’
বিজেপি-র বক্তব্য
বিজেপি নেতা সৌরভ শিকদার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, রাজ্য সরকারের ব্যর্থতার জন্য পশ্চিমবঙ্গ তো অনেক দিন ধরেই জঙ্গিদের স্বর্গরাজ্য ও আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। তারা সীমান্ত পেরিয়ে আসে। তৃণমূলের পঞ্চায়েত বা অন্যদের সাহায্য নিয়ে পরিচয়পত্র থেকে পাসপোর্ট হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রী নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে বিএসএফের দিকে, পুলিশের দিকে আঙুল তুলেছেন।’’
সৌরভ আরো বলেন, ‘‘মমতা বলছেন এসপি দায়ী। তাহলে তো তিনিও দায়ী। নিজের ব্যর্থতা থেকে নজর ঘোরানোর জন্য প্রলাপ বকছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে যতটা চিন্তিত, কাশ্মীর নিয়েও বোধহয় তাদের ততটা চিন্তা করতে হয় না৷’’
বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে হিন্দু, বৌদ্ধসহ যে সংখ্যালঘুরা ২০১৪ সালের আগে ভারতে এসেছেন, তাদের সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেয়া হচ্ছে। পরে যারা এসেছেন, তারা যাতে উদ্বাস্তু হিসাবে থাকতে পারেন, তা আমরা নিশ্চিত করতে চাই৷’’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ কিশোর এবিপি আনন্দকে বলেছেন, ‘‘ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে যারা ধরা পড়ছে, তারা বাংলাদেশি।ষ তাদের আধার কার্ড পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয় কেন?'' তিনি মনে করেন, ''হিন্দুদের ভয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এই কথা বলছেন৷’’
মূল লক্ষ্য হিন্দু ভোট?
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, ‘‘মমতার এই মন্তব্য বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে হবে না। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ আসার পর তিনি সোচ্চার হন। তারপর তিনি দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরের কাজ দেখতে যাওয়ার সময় সঙ্গে ইসকনের সন্ন্যাসীকে নিয়ে গিয়েছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডেও ইসকনের প্রতিনিধি থাকবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। আসলে এই পুরো কাজটাই তিনি করছেন হিন্দু ভোটকে সংহত করার জন্য৷’’
শুভাশিস ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ‘‘মমতা নিশ্চিত যে, তিনি মুসলিম ভোট পাবেন। বিজেপির সঙ্গে তার ভোটের পার্থক্যটা বিশাল নয়। এই অবস্থায় তিনি কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। তাই হিন্দুদের ভোট, বিশেষ করে শহরাঞ্চলের দিকে হিন্দুদের ভোট তৃণমূলের দিকে আনতে চাইছেন। বছরখানেকের মধ্যেই তাকে পুরসভা নির্বাচনের মুখোমুখিও হতে হবে৷’’
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা মনে করেন, ‘‘বিজেপিও হিন্দু ভোটের সিংহভাগ পাওয়ার চেষ্টা করছে। সেজন্য তারাও সিএএ, নাগরিকত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলছে। মমতাও একই ধরনের রাজনীতি করছেন। অনুপ্রবেশ, মাদ্রাসা নিয়ে একসময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও সোচ্চার হয়েছিলেন। কংগ্রেসও তাদের সুবিধামতো এই কাজ করে থাকে। তাই দেখা যাচ্ছে, সব দলই ভোট রাজনীতিতে একই পথে হাঁটছে।''
বার্তাসংস্থা পিটিআইয়ের পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান এবং দ্য সেক্রেটারিয়েটের কার্যনির্বাহী সম্পাদক জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বিজেপি অনুপ্রবেশের প্রশ্ন তুলে মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়কে বিপাকে ফেলার চেষ্টা করেছে এবং করছে। তারই পাল্টা দিয়েছেন মমতা। তিনি অনুপ্রবেশকে সামনে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন৷’’
জয়ন্তর মতে, ‘‘মমতা প্রথম থেকেই হিন্দু ও সংখ্যালঘু দুইটি কার্ডই খেলেন। তৃণমূল তৈরির পর তিনি নরম হিন্দুত্বের লাইন নিয়েছিলেন। পরে তিনি সংখ্যালঘু কার্ড খেলেছেন। আবার প্রয়োজেন হিন্দু কার্ড খেলতেও দ্বিধাবোধ করেননি। বিজেপি তো হিন্দু কার্ড খেলতে সিদ্ধহস্ত। অতীতে বামেরাও এই কার্ড খেলেছে। বাম জমানাতেও বারবার অভিযোগ উঠেছে, তারা অনুপ্রবেশে মদত দিচ্ছে বা ঠেকাতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ফলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, ধর্ম দুটোই ভালোভাবে ঢুকে গেছে৷’’
লেখক ও সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় একসময় সংসদে অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। সেসসময় ক্ষমতায় ইউপিএ সরকার। তারপর তার বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ওঠে। সিপিএমের বিরুদ্ধেও অতীতে এই অভিযোগ উঠেছে। অনুপ্রবেশে উৎসাহ দেয়া বা অনুপ্রবেশে সাহায্য করার অভিযোগ থেকে কেউই মুক্ত নয়৷’’
দীপ্তেন্দ্রর মতে, ‘‘এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একের পর এক জঙ্গি ধরা পড়ার পর তৃণমূলের উপর চাপ বেড়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সংগঠিত নয়। কিন্তু তারপরেও হিন্দু-ব্যাকল্যাশ হলে বিজেপির ভোট কয়েক শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। তখন কম ভোট পেয়েও তাদের তৃণমূলের থেকে বেশি আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টা দেখতে হবে৷’’