‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা যত কমবে, গুজব তত বাড়বে'
১৪ আগস্ট ২০২০ডয়চে ভেলে : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জেনে না জেনে বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করেন অনেকে৷ এতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এই মাধ্যমে মানুষ সেগুলোই শেয়ার করে যেগুলো সে বিশ্বাস করতে চায়৷ যে জিনিসগুলো তার পছন্দ হয় সেগুলোই সে নিয়ে নেয়৷ এভাবেই ছড়ায়৷ এগুলো একটা গোপনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়৷ প্রকাশ্য হয় না, কিন্তু এর প্রভাব পড়ে৷
আমরা দেখেছি, অনেকে ভুল তথ্য শেয়ার করার পরও সেটা অনেকে প্রত্যাহার করেন না...
ভুল তথ্য মানুষ দুই কারণে দেয়৷ একটা ইচ্ছে করে দেয়৷ অর্থাৎ, বানিয়ে দেয় রংচং মিশিয়ে৷ আরেকটা কারণ হলো, যে দিচ্ছে সে হয়তো নিজে তৈরি করেনি, শুনেছে৷ কিন্তু ওইটা তার পছন্দ হয়েছে৷ আর প্রত্যাহার করা না করা সমান৷ কারণ, এটা ছড়িয়ে পড়লে যারা বিশ্বাস করার তারা করে ফেলবে৷ এই কারণে প্রত্যাহার করার কোনো তাৎপর্য নেই৷ কারণ, এটা তো গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়ে৷ এগুলো তো তথ্য নয়, গুজব৷
অনেকের মৃত্যুর সংবাদ না জেনে ফেসবুকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷অথচ তিনি মারা যাননি৷ ওই পরিবারটি তো চরম বেকায়দায় পড়ে, তাই না?
অবশ্যই৷ এটা তো খুবই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজ৷ এটা তো শুধু পরিবার নয়, তার অনুরাগীদের উপরও প্রভাব পড়ে৷ এটা একটা মিথ্যাচার৷ কেউ যদি ইচ্ছে করে দেয় তাহলে সে অন্যায় কাজ করে৷ তাছাড়া অন্যের কাছ থেকে শুনে, যাচাই না করে দিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত না৷ আমি মনে করি এটা খুবই অন্যায় কাজ৷
সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই ভুল তথ্য দিয়ে যথারীতি তারকা হয়ে উঠেছেন৷ তাদের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন...
এদের খুব খারাপভাবে দেখবো৷ এটা তো প্রতারণার শামিল৷ একটা খবর সে বানালো বা যাচাই না করেই বলে দিলো এবং মুখরোচক হওয়ার কারণে অনেকেই শুনলো৷ এতে সে বড় হয়ে গেল৷ এই ধরনের প্রতারণা ঠিক না৷ এই ধরনের প্রতারণা পরিহার করা দরকার৷ এই ধরনের প্রতারণা চলে কেন সেটাও আমাদের দেখতে হবে৷ মানুষ যখন আসল খবরটি পায় না, গুজব তখনই তৈরি হয়৷
সমাজে এসব খবরের কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
এটা তো সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে৷ এই ধরনের প্রতারণামূলক খবর দিয়ে এক ধরনের খ্যাতি অর্জন করা, ফলোয়ার তৈরি করার প্রভাব তো খারাপই হবে৷ এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু কতটা খারাপ আমরা হয়তো তার পরিমাপ করতে পারবো না৷
যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তারা তো আইনগত ব্যবস্থাও নিতে পারছেন না?
এটা একটা বড় সমস্যা৷ যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা ব্যবস্থা নিতে পারে না৷ ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যেটা আছে, সেটা কিন্তু এ থেকে রক্ষা করে না৷ শুধুমাত্র যারা রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, ছোট হোক আর বড় হোক, তারা একটা মামলা ঠুকে দিলে তাকে ধরে নিয়ে আসছে৷ এই আইনটার সুবিধা ব্যক্তিরা পাচ্ছেন না৷ এই ধরনের সুযোগ থাকা উচিৎ বলে আমি মনে করি৷ এগুলো আবার যাচাই করে দেখতে হবে৷ কারণ, এটাও একটা মিথ্যাচার হতে পারে৷ ফলে মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে আরেকটা মিথ্যাচার দিয়ে তো আর কাজ হবে না৷ কাজেই এগুলো যাচাই-বাছাই করতে হবে৷
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কি যা ইচ্ছে তা-ই করা সম্ভব?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো যা ইচ্ছে তাই করা যাচ্ছে৷ কিন্তু এটা যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের একটা মনিটরিং থাকা দরকার৷ যেটা মিথ্যা সেটা যেন তারা দেখে৷ যারা এটার দায়িত্বে আছে বা যারা এটা চালাচ্ছেন, তাদের উপরই দায়িত্বটা বর্তায়৷ সরকারের ভূমিকাও থাকবে৷ সরকার ওই কোম্পানিকে বলবে৷ গভমেন্ট তো কোনো অলৌকিক বিষয় না, গভমেন্টও ব্যক্তি৷ যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, তাদেরই এটা দেখা উচিত৷ সরাসরি সরকারের হস্তক্ষেপটা আমার পছন্দ না৷ তখন এটার অপব্যবহার হতে পারে৷
শুধু সামাজিক মাধ্যম না, পত্রিকা বা অনলাইনেও তো অনেক ‘গল্প' ছাপা হচ্ছে৷ মানুষ এগুলো অনেক সময় বিশ্বাসও করছেন..,
মানুষের কোনো অপরাধ আমি দেখি না৷ যারা করছে, তারা হয়তো ইচ্ছে করেই করছে৷ মানুষ তো আসল খবর পাচ্ছে না৷ অবাধ তথ্য প্রবাহের কথা বলা হয়, কিন্তু আসলে তো তথ্য প্রবাহ নেই৷ খবর তো নিয়ন্ত্রিত৷ বিশেষ করে যে সমস্ত খবর মানুষ জানতে চায়, সেই বিষয়ে তারা খবর পায় না৷ রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক অনাচারের খবর মানুষ জানতে চায়৷ কিন্তু সেগুলো পায় না৷ তখন গুজব ছড়ালে মানুষ খুশি হয়৷ তখন মনে করে একটা কিছু হচ্ছে৷ তখন মানুষ অন্যায্য আনন্দ পায়৷
এই ধরনের ভুল খবর যারা ছড়াচ্ছে, তাদের কিভাবে নিবৃত্ত করা যায়?
ওই যে, যে মাধ্যম এটা প্রচার করছে আমি সেই মাধ্যমের উপরই দায়িত্ব দিতে চাই৷ তথ্য প্রবাহকে অবাধ করা দরকার৷ সত্যি তথ্য যাতে প্রচার পায়, সেই স্বাধীনতা দেওয়া দরকার৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা খুবই জরুরি৷ যে গুজবগুলো ছড়ানো হয় তার মধ্যে মতও থাকে৷ এটা যে একটা নিরপেক্ষ জিনিস, তা নয়৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতাটা খুবই জরুরি৷
সংবাদমাধ্যমে কি তাহলে সঠিকভাবে মত প্রকাশ হচ্ছে না?
না, হচ্ছে না৷ সংবাদপত্র তো নানান রকমের প্রভাবের মধ্যে আছে৷ যারা বিজ্ঞাপন দেয় তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ মালিকের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক অবস্থান তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়৷ সরকার অপছন্দ করবে কিনা এ বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে হয়৷ সংবাদপত্রে স্বাধীনতার অভাব তো অনেক দিনের পুরনো, এখনো সেটা আছে৷
সামাজিক বা অনলাইন মাধ্যম আরো পরিশীলিতভাবে কিভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব?
আমি যেহেতু প্রাচীণপন্থি লোক তাই সংবাদপত্র ও টেলিভিশনকে গুরুত্ব দিতে চাই৷ সংবাদপত্রে একটা খবর দিলে দায়িত্ব নিয়ে দেয়৷ টেলিভিশনে একটা খবর গেলে তারাও দায়িত্ব নিয়ে দেয়৷ সামাজিক মাধ্যম বা অনলাইনে যারা দিচ্ছে তাদের কোনো দায়িত্ব নেই৷ যা ইচ্ছে তাই দিয়ে দিচ্ছে৷ আমি মনে করি, যেগুলো প্রচলিত গণমাধ্যম, যাদের দায় থাকে, তাদের আরো শক্তিশালী করা দরকার৷ সঠিক খবর দিতে পারার সুযোগ দেওয়া দরকার৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা না দিলে তো গুজব তৈরি হবে৷ মত প্রকাশের স্বাধীনতা যত কমবে, গুজব তত বাড়বে, এটাই নিয়ম৷