ভূমধ্যসাগরে ট্র্যাজেডি রোখা সম্ভব
১৬ এপ্রিল ২০১৫ইউরোপে বসন্ত এসেছে, সেই সঙ্গে উদ্বাস্তুদের আগমনও শুরু হয়েছে৷ এ বছরের বসন্তে ভূমধ্যসাগর থেকে যে ধরনের ছবি ও বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, গত বছরের বসন্তেও ঠিক তাই ছিল৷ শুধু সংখ্যাটাই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷
২০১৪ সালে মোট দু'লাখ ত্রিশ হাজার শরণার্থী সাগর পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছন; সে তুলনায় এ বছর উদ্বাস্তুদের সংখ্যা বেড়েছে ৬০ শতাংশ৷ আর কতো মানুষ যে সাগরের জলে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই – লিবিয়ার উপকূলে যেমন ঘটল৷
ইইউ হাত কচলাচ্ছে
ব্রাসেলসের প্রতিক্রিয়াও একই রয়ে গেছে৷ দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা তাদের দুঃখ ও শোক প্রকাশ করেছেন এবং মানুষ পাচারকারীদের অশুভ কার্যকলাপের কথা বলেছেন৷ ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্বাস্তু কমিশনার দিমিত্রিস আভ্রামোপুলোস বলেছেন, উদ্বাস্তুদের বিপুল সংখ্যায় আসাটাই এবার স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াবে, কাজেই ইউরোপের তার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত৷
আভ্রামোপুলোস নাকি আগামী মাসে একটি নতুন উদ্বাস্তু নীতি পেশ করবেন – তবে তাতে যে কুলোবে না, তা এখনই বলা চলে৷ এছাড়া ইইউ-এর যাবতীয় সদস্য দেশের তা অনুমোদন করতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাবে – তাও শেষমেষ সেই নীতিকে অনেক জোলো করে৷ কেননা অভিবাসন ও উদ্বাস্তু সংক্রান্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ব্রাসেলসে নয়, সদস্য দেশগুলির হাতে৷ এবং সেখান থেকে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না৷
শুধু বিপর্যয় ত্রাণ নয়
কিছু কিছু ত্রাণ সংগঠন এবং সেই সঙ্গে ইউরোপীয় সংসদের কিছু বিধায়ক দাবি করছেন যে, ভূমধ্যসাগরে উদ্বাস্তুদের ত্রাণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থপুষ্ট প্রকল্পটি পুনরায় চালু করা হোক - যেমন ইটালির ‘‘মারে নোসত্রুম'' কর্মসূচি, যার খরচ ছিল মাসে ৯০ লাখ ইউরো৷
ব্রাসেলসের পক্ষে ‘‘মারে নোস্ট্রুম''-এর অর্থসংস্থান করা অসম্ভব ছিল না, যদি না তাতে ইংল্যান্ড ও জার্মানির মতো দেশের আপত্তি থাকতো৷ ইটালির ঐ ত্রাণ অভিযানের ফলে নাকি উদ্বাস্তুরা ইউরোপে আসার প্ররোচনা পায় এবং মানুষ পাচারকারীদেরও সুবিধা হয়৷ এমনকি জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেমেজিয়ের সে সময় ‘‘ভরতুকি'' দেওয়ার কথাও বলেছিলেন৷
ইটালি কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপেই ‘‘মারে নোস্ট্রুম'' বন্ধ করেছে৷ সরকার নাগরিকদের বোঝাতে পারেননি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছ থেকে সাহায্য না পাওয়া সত্ত্বেও নৌবাহিনী ক্রমেই আরো বেশী শরণার্থীকে দেশে নিয়ে আসছে কেন৷
ওদিকে ‘‘মারে নোসত্রুম'' চলাকালীনই তিন হাজারের বেশি উদ্বাস্তু ইউরোপে আসার প্রচেষ্টায় প্রাণ হারান৷ ইইউ-এর পরবর্তী প্রকল্প ‘‘ট্রাইটন''-ও উদ্বাস্তুদের প্রাণ বাঁচানোর কাজ করে চলেছে৷ ইটালির নৌবাহিনী আগের মতোই লিবিয়ার উপকূলে টহল দিচ্ছে – বিগত কয়েকদিনে যেমনটা দেখা গেছে৷ অপরদিকে এও বলতে হয়, আরো বেশি মানুষকে সাগর থেকে উদ্ধার করার চেয়ে লিবিয়া থেকে ইউরোপ অভিমুখে ফেরি চলাচলের ব্যবস্থা করলেই তো হয়: সেই পন্থায় অন্তত মানুষ পাচারকারীদের মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করা যাবে এবং উদ্বাস্তুদের আরো বেশি নিরাপত্তা দেওয়া যাবে৷
উদ্বাস্তু নিয়ে ইউরোপীয় বিতর্ক ফাঁকি
ইউরোপীয় উদ্বাস্তু সমস্যার মুশকিল এই যে, সকলেরই পেটে এক, মুখে এক৷ সিরিয়া, ইরিট্রিয়া, মালি, নাইজেরিয়া, ইয়েমেনের মানুষরা গৃহযুদ্ধ, হত্যা, নিপীড়নের হাত থেকে পালাচ্ছেন – অন্যদিকে ইউরোপের দেশগুলি তাদের নিতে রাজি নয়৷ সে ক্ষেত্রে জার্মানিকে আদর্শ বলা চলতে পারে৷
জার্মানি নীরবে আরো বেশি উদ্বাস্তু নেওয়া শুরু করেছে এবং এ দিক থেকে আজ ইউরোপীয় দেশগুলির শীর্ষে – যদিও এখানেও উগ্র দক্ষিণপন্থি গোষ্ঠীগুলি জনসাধারণকে উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করছে৷ প্যারিস কিংবা লন্ডনের সরকারবর্গ তো স্বদেশে দক্ষিণপন্থিদের পালে হাওয়া দেখে আপাতত মুখ খুলতেই নারাজ৷ ওদিকে ইটালি এবং গ্রিসের মতো যে সব দেশে উদ্বাস্তুরা সর্বাগ্রে পদার্পণ করে, তারাও তাদের স্বভাবসিদ্ধ পন্থায় প্রতি মাসে হাজার হাজার উদ্বাস্তুকে উত্তরমুখে পাঠিয়ে যাচ্ছে৷
ইউরোপে উদ্বাস্তু শিবির?
বাস্তব হল, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই৷ উত্তর আফ্রিকার যে সব দেশ হয়ে আজ উদ্বাস্তুরা আসে, তাদের বিশেষ সাহায্য দিয়েও কোনো লাভ নেই, কেননা লিবিয়ার মতো বস্তুত অরাজক ‘‘ব্যর্থ রাষ্ট্র'' থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন রোখা একমাত্র সামুদ্রিক অবরোধের মাধ্যমে সম্ভব৷
সেক্ষেত্রেও উদ্বাস্তুরা আসবে মিশর কিংবা টিউনিশিয়া হয়ে৷ স্বয়ং তুর্কি সরকার এ ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সহযোগিতা করতে রাজি নন৷ কাজেই উদ্বাস্তুদের স্রোত আটকানো সম্ভব না হলে এবং ইইউ দেশগুলি তাদের নিতে রাজি না থাকলে হয়তো শেষমেষ দক্ষিণ ইউরোপে উদ্বাস্তু শিবির সৃষ্টিই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়াতে পারে৷