ভালোবাসতে পয়সা লাগে না
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫মাসাজ পার্লারে গেলে টাকা খরচ হতো৷ এয়ারপোর্ট বলে আরামটা পেলাম বিনা খরচে৷ দীর্ঘদেহী, কেতাদুরস্ত এক জার্মান টিপে দিলো পা! নিমেষে অপর্যাপ্ত ঘুমের অস্বস্তি, বিরক্তি সব উধাও৷ পা আবার টিপে দেযার অনুরোজ জানিয়ে আমি ‘নখ আইনমাল, বিটে' বলায় উল্টো জার্মান ভদ্রলোকই পড়লেন লজ্জায়৷ আমি হাসছি, পাশ থেকে তাঁর এক তরুণী সহকর্মীও হাসছে দেখে ভদ্রলোক নিজেও আর না হেসে পারলেন না৷
কয়েক বছর ধরে এয়ারপোর্টগুলোতে এই এক যন্ত্রণা৷ নিরাপত্তার অজুহাতে যাত্রীদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হয় যা মাঝে মাঝে মানসিক অত্যাচারের পর্যায়েও পৌঁছে৷ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এ কর্মযজ্ঞের নাম দিয়েছে ‘সিকিউরিটি চেকিং'৷ ‘ক্রসফায়ার' যেমন নিছক ‘বন্দুকযুদ্ধ', সিকিউরিটি চেকিংও তেমনি শুধুই নিরাপত্তার স্বার্থে একটু দেহতল্লাসি৷ কোনো যাত্রীর কাছে কোনো মারণাস্ত্র লুকানো আছে দেখতে হবে না! তা দেখতেই জুতো, মোজা, কোট, জ্যাকেট, বেল্ট সব খোলানো, আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু'হাত তুলে দাঁড় করানো এবং তারপর শরীরের কিছু অংশে, বিশেষ করে পায়ে হাত চালিয়ে গোপন কিছুর উপস্থিতি পরখ করার চেষ্টাও করতে হয়৷ বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীকেও কতবার নাজেহাল হতে হয়েছে, আমি তো কোন ছার!
শুক্রবার সকালে কোলন বিমানবন্দরে অবশ্য এত কিছু হয়নি৷ কিন্তু একে একে সবই করা হবে এই ভয় এবং ভয়জনিত বিরক্তি আগে থেকেই ছিল৷ কিন্তু বিরক্তিটা এই প্রথম আনন্দ হয়ে গেল৷ জ্যাকেট খুলে দিলাম, কয়েনগুলোও রাখলাম ট্রে-তে৷ পাথর মুখ করে দীর্ঘাঙ্গী নিরাপত্তা কর্মকর্তা বললেন, জুতোর নীচটা দেখাতে৷ ভাবলাম, ‘‘এরা তো বেশ ভালো, জুতো-মোজা খুলতে বলছে না!'' পা তুলে দেখালাম৷ ‘‘আহ, কী সুন্দর করে পা টিপেও দিচ্ছে!'' দু'পা একবার করে টেপা শেষ হতেই বললাম, ‘‘নখ আইনমাল, বিটে৷''
বার্লিনেও বারবার ‘নখ আইনমাল, বিটে' – বলতে ইচ্ছে হয়েছে৷ বেশ কিছু ভালো ছবি দেখানো হয়েছে বার্লিনালে-তে৷ এ ধরণের ছবি একবার দেখলে বারবার দেখতে ইচ্ছে হয় এবং তখন ‘নখ আইনমাল, বিটে'-ও বলার ইচ্ছে জাগে৷
ইউরোপের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালে উপলক্ষ্যে বার্লিনের প্রায় সব কোণেই লেগেছিল রূপালি পর্দার রূপালি উৎসবের রং৷ প্রতি বছর এই সময়টায় বার্লিন আরো মোহনীয় হয়ে ওঠে৷ বছরের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের টানে কয়েক লক্ষ মানুষ আসে ‘বার্লিনালে'-তে৷
ইদানীং বার্লিন সম্পর্কে দুটি কথা খুব গর্ব করে প্রচার করা হয়৷ এক, বার্লিন এখন পর্যটকদের চুম্বকের মতো টানে৷ ২, শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্র প্রেমীদের জন্য বার্লিনের সেরা চুম্বক এখন বার্লিনালে৷
৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়ে কাগজে-কলমে ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হলেও কার্যত ১৪ ফেব্রুয়ারিই শেষ হয়ে যায় এবারের উৎসব৷ মাত্র একদিন আগে গিয়েছি৷ মূল আয়োজনে তখন শুধু বিজয়ীদের নাম ঘোষণা এবং পুরস্কৃত করা বাকি৷ প্রতিযোগিতার ছবিগুলোর প্রদর্শনী প্রায় শেষ৷ তবে অন্য ছবিগুলো দেখানো হচ্ছিল এবং সে কারণে বার্লিনের প্রতিটি প্রেক্ষাগৃহে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল দর্শক৷ শার্লট ব়্যাম্পলিং এবং টম কার্টনি অভিনীত ‘ফর্টি ফাইভ ইয়ার্স' ছবি দেখতে যেমন সব বয়সি মানুষের ঢল দেখেছি, জাপানের ছবি, ‘টেন নো চসুকে' দেখতে যাওয়া মানুষেরও অভাব পড়েনি৷ সবচেয়ে বেশি উন্মাদনা ছিল অবশ্য ‘সিন্ডারেলা' নিয়ে৷ হলের ভেতরে-বাইরে এ ছবিকে ঘিরে শিশু-কিশোরদের কলতান উৎসবকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত, অনেক বেশি আনন্দময় করেছে৷
অথচ ‘সিন্ডারেলা' কিন্তু মূল প্রতিযোগিতার বাইরে ছিল৷ জনপ্রিয়তার কাছে মাথা নত করে না – অনেকের মতে এটা বার্লিনালের সবচেয়ে ভালো দিক৷ তবে বার্লিনালের সমালোচনাও যে নেই, তা নয়৷ এবারের আয়োজনে বাংলাদেশের কোনো ছবি না থাকা প্রসঙ্গে বাঙালি মহলে বার্লিনালের সমালোচনাই শুনেছি৷ জার্মান প্রবাসী বাংলাদেশি পরিচালক শাহীন দিল-রিয়াজও এ নিয়ে কিছুটা হতাশ৷ ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে ছবি নির্বাচনের বেলায় বার্লিনালে আয়োজকরা কী নীতিমালা অনুসরণ করেন তা এখনো বুঝে উঠতে পারেননি শাহীন৷
বাংলাদেশের ছবি না থাকলেও এবারের আয়োজনে ভারতের অংশগ্রহণ ছিল৷ গ্রামের দুই শিশুকে নিয়ে তৈরি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘ধানাক' নিয়ে বার্লিনে এসেছিলেন পরিচালক নাগেশ কুকুনুর৷ ছবিটি সেরার স্বীকৃতি না পেলেও ‘স্পেশাল মেনশন'-এর বাহবা পেয়েছে৷
সাধারণ দর্শকদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছে ‘সিন্ডারেলা'৷ কেনেথ ব্রানাঘ-এর এ ছবি এক কথায় মাৎ করেছে আসর৷ মায়ের কোলে বসেও এলার কষ্ট দেখে বিষন্ন হয়েছে অনেক শিশু, আবার আনন্দ দেখে হাততালিও দিয়েছে৷ ‘সিন্ডারেলা' ছবিতে এলা হয়েছেন লিলি জেমস৷ কম বয়সি সব দর্শকের মন জিতে নিয়েছেন তিনি৷ তবে সিন্ডারেলার সৎ মা-এর কুট চরিত্রে অভিনয় করেও কেট ব্ল্যাঞ্চেট অভিনয় গুণেই ছুঁয়ে গেছেন সব শ্রেনির দর্শকদের হৃদয়৷
একটি দৃশ্যে দুবারের অস্কার জয়ী কেট ব্ল্যাঞ্চেট আর লিলি জেমসের এক টুকরো কথোপকথন কিশোর-কিশোরীদের মনে হয়ত জীবনের মন্ত্র হয়ে থেকে যাবে৷ দৃশ্যে সৎ মা লেডি ট্রেমাইন তাঁর সৎ মেয়ে এলা, অর্থাৎ সিন্ডারেলার কাছে জানতে চাইছেন, ‘‘এই কাচের এক পাটি জুতো তুমি কোথায় পেলে?'' সিন্ডারেলা বলছে, ‘‘কুড়িয়ে পেয়েছি৷'' সৎ মা শ্লেষভরে এ জবাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘‘কোনো দামি জিনিস বিনে পয়সায় পাওয়া যায় না৷'' সিন্ডারেলার জবাব, ‘‘ভালোবাসার জন্য কোনো পয়সা খরচ করতে হয় না (লাভ ইজ ফ্রি)৷''
পৃথিবীতে কিছু মানুষ ঘৃণা ছড়ায়, মানুষ মেরে দম্ভ করে৷ তাদের কারণে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে ভুগতে হয় নিরীহ মানুষদের৷ এর উল্টো দিকটা দেখুন৷ সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে সবাইকে বাঁচাতে গিয়ে বিনে পয়সায় কত লোকের পা টিপে দেয় জার্মান, মার্কিন, ব্রিটিশ, রুশ কিংবা অন্যান্য দেশের নিরাপত্তাকর্মীরা৷ এখনো বিনে পয়সায় অনেক কিছুই পাওয়া যায়৷ পা টেপানো....ভালোবাসাও!