ভারতে শিশুশ্রম, ব্রাজিলের বন উজাড় – নেই কোন মাথাব্যথা
১৯ জুন ২০১১ইউরোপীয় কমিশনের দপ্তরে কাজ করেন থোমাস ডড৷ আন্তর্জাতিক বেশ কিছু কোম্পানির লিফলেট তাঁর টেবিলে শোভা পাচ্ছে৷ তার মধ্যে রয়েছে অ্যামেরিকান টোব্যাকোর একটি ঝকঝকে লিফলেট৷ থোমাস ডড ইউরোপীয় কোম্পানির বিভিন্ন নীতিমালা এবং কৌশল প্রণয়নের কাজ করেন৷ এসব কোম্পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করে৷ অনেক দেশেই ইউরোপীয় কোম্পানির শাখা অফিস রয়েছে বা থাকে৷
প্রশ্ন উঠেছে সব দেশের পক্ষেই কি এই নীতিমালাগুলো মেনে চলা সম্ভব? চীন এবং ভারতের মত জনবহুল দেশে এসব নীতিমালা প্রণয়ন করা কি সহজ? ইউরোপের ৫০ কোটি মানুষের জন্য যে নীতিমালা তা কি অন্য দেশে চলবে?
তবে ডড জানালেন,‘ইদানিং অনেক কোম্পানিই মানবাধিকারের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে৷ বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তারা চিন্তিত হচ্ছে৷' তবে এ কথাও তিনি স্বীকার করেন যে, ইউরোপীয় অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শাখা রয়েছে এবং সেখানে শ্রমের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ কম বেতনে কাজ করিয়ে নেয়া হচ্ছে৷ উন্নয়নশীল দেশ ছাড়াও দ্রুত বিকাশমান দেশগুলোতেও একই কাজ করছে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলো৷
পোশাক শিল্পে বৈষম্য, ব্যবসার নামে শোষণ
জার্মান সংস্থা জার্মান ওয়াচ জানিয়েছে, পোশাক রপ্তানি ব্যবসায় চীন থেকে অল্প মজুরিতে কাজ করিয়ে আনা হচ্ছে৷ জার্মান সুপার মার্কেট চেন ‘আলডি'-তে যেসব পোশাক বিক্রি হয় সেগুলো উন্নয়নশীল দেশে তৈরি করা হয়৷ এবং তাদের মজুরি খুবই নগণ্য৷ এই তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর ‘আলডি' ‘বিজনেস সোশ্যাল কমপ্লাইয়েন্স ইনিশিয়েটিভ' সংক্ষেপে বিএসসিআই অর্থাৎ ব্যবসার সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলতে রাজি হয়৷ ‘আলডি'-র দেখাদেখি আরো প্রায় ৫০০ কোম্পানি একই রীতি অনুসরণ করে৷ কাজের পরিবেশ, কর্মীদের সুস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা – এসবের দিকে নজর রাখার অঙ্গীকার করে৷ তবে এই নীতি সত্যি সত্যিই কোম্পানিগুলো মেনে চলছে কিনা তা কখনোই খতিয়ে দেখা হয় না৷
তবে ইইউ পর্যায়ে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে৷ ‘ইউরোপীয় কোয়ালিশন ফর কর্পোরেট জাস্টিস' সংক্ষেপে ইসিসিজে সংস্থার দাবিও তাই৷ প্রায় ২৫০টি ইউরোপীয় এনজিও নিয়ে তারা একটি প্রকল্প শুরু করেছে৷ এর মধ্যে জার্মান ওয়াচও রয়েছে৷ এই প্রকল্পের কাজ করা হবে ব্রাসেলস থেকে৷ বলা হয়েছে, ইউরোপীয় প্রতিটি কোম্পানি এবং তার শাখা কোম্পানি তাদের পণ্যের জন্য তৃতীয় আরেকটি দেশের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য৷ তাহলে, নিয়ম নীতি মেনে চলার দায়-দায়িত্ব শুধু মূল দেশের হাতেই থাকবে না, আরেকটি দেশও নজর রাখতে পারবে৷ দ্বিতীয়ত প্রতিটি কোম্পানিকেই কাজের পরিবেশ, প্রতিটি শাখায় কতজন কর্মী কাজ করে, তাদের বেতন কত, সুযোগ-সুবিধা কেমন – এসব জানিয়ে রিপোর্ট পেশ করবে৷ ভোক্তা তখন এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেবে সে পণ্যটি ক্রয় করবে কিনা৷
অধিকার চাই, সুউচ্চ কন্ঠস্বর কোথা পাই?
ইসিসিজি-র কর্মী গুস্তাভো হের্নান্দেজ জানান, ‘‘তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের যে ক্ষতিসাধন করছে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো এর ফলে তৃতীয় বিশ্বের মানুষদের ইউরোপীয় আদালতে মামলা করার অধিকার থাকতে হবে৷'' অর্থাৎ ‘আলডি'র বিরুদ্ধে চীনে পোশাক শিল্পে নিয়োজিত কর্মীর অধিকার থাকবে জার্মান কোম্পানির বিরুদ্ধে জার্মানিতে মামলা করার৷ কেন এই অধিকার থাকা প্রয়োজন? উত্তর দিলেন থোমাস ডড, ‘‘সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সে দেশকে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ যা হচ্ছে তা এক ধরণের অপরাধ তা তাদেরকেই প্রমাণ করতে হবে৷ মামলা তাদেরকেই করতে হবে৷'' তবে তা অনেক কঠিন কাজ৷ আর ঠিক কারণেই সে দেশগুলোতে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠায় তাদের সাহায্য করে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷
পশ্চিমা বিশ্বের দ্বৈত ভূমিকা
কিন্তু এত কিছুর পরও দেখা যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে৷ বেশ জোর দিয়েই কথাগুলো বলেন ইইউ সাংসদ গিগল্ড৷ তিনি জানান, ‘ইউরোপীয়রা আগের মতোই বেশ কিছু মূল্যবোধের আবিষ্কার করেছে৷ ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক শক্তিতে টিকিয়ে রাখতে বেশ কিছু দেশকে একত্রিত করেছে৷ বলা হচ্ছে, বোঝানো হচ্ছে – এটা হচ্ছে একটি স্বপ্ন যে স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রতিটি মানুষই দেখতে চায়৷ অথচ পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এই দেশগুলো ব্যবসার নামে কী করছে? আর ঠিক তখনই ইউরোপীয় এই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়, জোর দিয়ে কথা বলার সেই শক্তিও হারিয়ে যায়৷'
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়দার
সম্পাদনা: হোসাইন আব্দুল হাই