1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থাভারত

ভারতে বিচারপতিরাই প্রতিবাদ করেছিলেন

গৌতম হোড় দিল্লি
২৫ অক্টোবর ২০২৪

খবরটা শুনেই চমকে উঠেছিল গোটা দেশ। সুপ্রিম কোর্টের চার প্রবীণ বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলন করবেন।

https://p.dw.com/p/4mEJs
ছবিতে দুদিকে সবুজ গাছের মাঝখানে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ভবনটি দেখা যাচ্ছে৷
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট৷ছবি: picture-alliance/NurPhoto/N. Kachroo

তারপর ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি বিচারপতি চেলামেশ্বর সেই সাংবাদিক সম্মেলনে যে বোমাটি ফাটালেন, তার জন্য কেউই সম্ভবত তৈরি ছিলেন না। 

বিচারপতি মদন লোকুর, বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ, বিচারপতি রঞ্জন গগইকে পাশে বসিয়ে বিচারপতি চেলামেশ্বর সেদিন একেবারে চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে যে কথাটা বলেছিলেন, তা হলো, ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় বা সর্বোচ্চ আদালতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না। সুপ্রিম কোর্টে গত কয়েক মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে, যা কাঙ্খিত নয়।

বিচারপতি চেলামেশ্বর দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ''সুপ্রিম কোর্টের মতো সংস্থাকে রক্ষা করতে না পারলে ভারতে গণতন্ত্র বাঁচবে না। ভালো গণতন্ত্রের হলমার্ক হলো স্বাধীন ও পক্ষপাতহীন বিচার ব্যবস্থা।''

বিচারপতি চেলামেশ্বর সেদিন স্বীকার করে নিয়েছিলেন, তারা যা করছেন তা সচরাচর কোনো দেশেই হয় না। তা সত্ত্বেও তারা এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।

কোন কাজটা অস্বাভাবিক বলেছিলেন বিচারপতি চেলামেশ্বর? সেটা হলো, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের এইভাবে সাংবাদিক সম্মেলন করা। মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিক, তারকা, কোনো সংগঠনের পদাধিকারীরা, ক্রীড়াবিদ-সহ অন্যরা হামেশাই সাংবাদিক সম্মেলন করেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর মিডিয়ার মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর মানুষের কাছে পৌঁছাতে গেলে অনেকেই সাংবাদিক সম্মেলন করে থাকেন। কিন্তু তাই বলে বিচারপতিরা? না, তারা যা বলার আদালতে বলেন। তার বাইরে সাংবাদিকদের ডেকে পাঠিয়ে কোনো বিষয় বলার পথে তারা কখনোই হাঁটেন না। কিছু বিচারপতি টিভি বা খবরের কাগজে যে সাক্ষাৎকার দেননি এমন নয়, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম।

বিচারপতিদের সাংবাদিক সম্মেলন করে বা মিডিয়ার মাধ্যমে কোনো বিষয় মানুষকে জানানোর কোনো প্রথা কোনো দেশেই নেই। তারা সাধারণত মিডিয়ার ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন। একটা সময় পর্যন্ত তারা কোনো অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতেন না। এখনো ভারতে বিচারপতিরা প্রকাশ্য ভাষণও খুব বেশি দেন না।

কিন্তু বিচারপতি চেলামেশ্বর-সহ চার বিচারপতি সেই কাজটা করেছিলেন। তাদের মনে হয়েছিল, সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচানোটা অত্যন্ত জরুরি। আর তাদের মনে হয়েছিল, পরে কেউ যেন এই অভিযোগ না করতে পারেন, সব জেনেশুনে তারা চুপ করেছিলেন, তাদের আত্মাকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। এ সব যুক্তি চেলামেশ্বরই সেদিন দিয়েছিলেন।

কেন সুপ্রিম কোর্টকে বাঁচানোর কথাটা উঠেছিল? এই সাংবাদিক সম্মেলনের কয়েক মাস আগে চার বিচারপতি একটা চিঠি লিখেছিলেন সেসময়ের প্রধান বিচারপতিকে(দীপক মিশ্র)। সেই চিঠি তারা সাংবাদিকদের দিয়েছিলেন। তাদের সাংবাদিক সম্মেলন ও চিঠি থেকে স্পষ্ট হয়, প্রধান বিচারপতি কিছু গুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর মামলা জুনিয়র বিচারপতিদের বেঞ্চে দিচ্ছিলেন। এইভাবে মামলা দেয়ার মধ্যে কোনো স্বচ্ছ্বতা ছিল না বলে বিচারপতি চেলামেশ্বররা মনে করেন। পরে এই কথাটা তারা প্রধান বিচারপতির কাছে গিয়েও বলেছিলেন। তিনি বুঝতে বা মানতে চাননি। তাই সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন চার বিচারপতি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি গগই জানিয়েছিলেন, ওই মামলার মধ্যে সিবিআই বিচারক লোয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত মামলাও ছিল।

এই অভিযোগ কোনো মিডিয়া করেনি, কোনো রাজনৈতিক নেতা করেননি, বিরোধী দলের পক্ষ থেকে করা হয়নি, করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সেসময়ের চার সিনিয়র বিচারপতি। তারপর এ নিয়ে প্রচুর আলোড়ন দেখা দিয়েছিল। তর্ক-বিতর্ক প্রচুর হয়েছে। তবে এর একবছর পর ২০১৯ সালের ১২ জানুয়ারি হিন্দুস্তান টাইমস একটা খবর করে। সেখানে বলা হয়, চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের এক বছর পর পরিস্থিতিতে সামান্যই বদল হয়েছে। বিচারপতি চেলামেশ্বরের দাবি ছিল, পাঁচজন সবচেয়ে প্রবীণ বিচারপতি পরামর্শ করে কোন মামলা কোন বেঞ্চে যাবে তা ঠিক করুন। এক বছর পর যখন এই রিপোর্ট লেখা হচ্ছে, তখন বিচারপতি রঞ্জন গগই প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। তবে তিনিও একাই মামলার রোস্টার তৈরি করতেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেয়ার পর ২০২০ সালে রাষ্ট্রপতি তাকে রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য করেন। তিনি এখনো রাজ্যসভা সাংসদ।

স্বসাসিত সাংবিধানিক সংস্থায় যারা থাকেন, তাদের সংসদে বা বিধানসভায় আসা উচিত কি না, বিচারপতিদের সাংসদ হওয়া উচিত কি না, এনিয়ে ভারতে অনেক বিতর্ক হয়েছে। আমরা সেই বিতর্কে ঢুকব না। আমরা এখানে একটা কথাই বলবো, সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে এই যে এতবড় বিতর্ক, তা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে, আইনজীবীদের কাছ থেকে, রাজনীতিকদের কাছ থেকে আসেনি, এসেছে বিচারপতিদের মধ্যে থেকে। তাই বলে কি কারো কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষোভ-বিক্ষোভতো থাকবেই। কিন্তু তাই বলে বিচারপতিদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করার মতো ঘটনা ভারতে ঘটে না।

বিচারবিভাগ নিয়েও তো বিতর্ক কম হয়নি। জরুরি অবস্থার সময় সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। তার আগে পরেও হয়েছে। বিচারবিভাগের রায় নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকাটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। দিল্লিতে জেসিকা লাল হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। ১৯৯৯ সালের ঘটনা। দিল্লির একটি বারে অনেকের চোখের সামনে জেসিকা লালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। অভিযুক্ত হরিয়ানার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার ছেলে মনু শর্মা। নিম্ন আদালত তাকে অভিযোগমুক্ত বলে রায় দেয়। প্রবল জনরোষের পর সরকারি তরফে হাইকোর্টে আবেদন জানানো হয়। হাইকোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। আরজি কর কাণ্ডের পর সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকে মামলা শুরু করে।

বিলকিস বানো মামলায় বিচারপতি নাগরত্ন ও বিচারপতি ভুয়ান বলেছিলেন, ''জনগণের ক্ষোভ আমাদের বিচারের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে না। আমরা সেই ক্ষোভ অনুসারে কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। ধরুন, যদি কোনো গণবিক্ষোভ না থাকে, তাহলে কি আমরা নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখব? আর গণবিক্ষোভ হলে কি মনে করতে হবে, নিম্ন আদালতের রায় ভুল ছিল?''

বিচারপতিরা বিচার করেন সংবিধান ও আইন মেনে। তারা তদন্ত করেন না। পুলিশ বা অন্য তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে। তারপর তার উপর তারা নির্দেশ দেন। দরকার হলে সেই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। রিপোর্ট চান। সরকারের কাছ থেকে হলফনামা চান। কিন্তু তাদের বিচার হয় সংবিধান ও আইন মেনে। রায় পছন্দ না হলে, নিম্ন আদালতের ক্ষেত্রে উপরের আদালতে, সুপ্রিম কোর্টের ক্ষেত্রে বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদন করা যায়। বিচারপতিদের বিরুদ্ধেও আবেদন জানাবার একটি পদ্ধতি আছে। এমনকী বিরল ক্ষেত্রে সংসদও কোনো বিচারপতিকে ইমপিচ করতে পারে। বিচারকদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নিতে পারে।

যে কোনো গণতন্ত্রে বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় দুইটি বিষয়। সেখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ক্ষোভ-বিক্ষোভের ভূমিকা থাকতে পারে না। আসল কথা হলো, তারা সংবিধান অনুয়ায়ী কাজ করছেন কিনা। আর তাদের সরানোর ক্ষেত্রেও সংবিধান অনুসারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কি না। ভারতে এখনো পর্যন্ত এই গণতান্ত্রিক নীতি অনুসরণ করা হয়। তার মধ্যে ব্যতিক্রম থাকতে পারে, মানুষের এমনকী বিচারপতিদেরও ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকতে পারে, কিন্তু নিয়ম অনুসরণ করার বিষয়টিও একই সঙ্গে থাকে।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷