মুক্তিযোদ্ধাদের কবর
৩১ জুলাই ২০১২‘‘তরুণ-কিশোর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সামনে থেকে যুদ্ধ করেছি৷ সে সময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছেন৷ তাঁদের মনে আকুতি ছিল, তাঁদের মরদেহ যেন বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়৷ যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশে পাকিস্তানি সেনারা যখনই কোনো মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ পেত, সেগুলো বিকৃত করতো৷ কবরগুলোর অসম্মান করতো৷ তাই মুক্তিযোদ্ধাদের নো-ম্যানস ল্যান্ডে বা ভারতের কবরস্থানে কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরের আশপাশে কবরস্থ করতাম৷'' ডয়চে ভেলেকে এভাবেই কথাগুলি বললেন মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত লেঃ কর্নেল সাজ্জাদ আলি জাহির বীর প্রতীক৷
চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের পাঁচটি রাজ্য৷ পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় ও মিজোরাম৷ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব শহীদকে ভারতের মাটিতে কবরস্থ করা হয়, সেইসব কবর খুঁজে বের করা, শহীদদের দেহাবশেষ উদ্ধার করা এবং স্বদেশের মাটিতে যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের স্মৃতিরক্ষা করা - এই দুরূহ কাজটা কীভাবে শুরু করলেন? সাজ্জাদ আলি জাহিরের কথায়, ‘‘ভারতের বিভিন্ন জায়গায় গেছি৷ সীমান্ত এলাকার গ্রামবাসীদের সঙ্গে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের যাঁরা সাহায্য করেছিল তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাঁরা অনেক তথ্য দিয়েছে৷ ভারতের বিভিন্ন সরকারি অফিস, বিএসএফ, জেলা শাসক আর থানা থেকেও অনেক তথ্য পাই৷ ঐসব তথ্যের ভিত্তিতে কবরস্থানগুলিতে গিয়ে মোতয়ালি, ইমাম সাহেব, গ্রেভ ডিগারদের কাছ থেকে জানতে পারি কোথায় কতগুলি কবর আছে৷ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় মিত্র সেনাদের কাছ থেকেও অনেক তথ্য পাই৷ এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া৷''
লেঃ কর্নেল সাজ্জাদের অবিচল নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম দেখে তাতে সামিল হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার এবং সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতও৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং-এর ঢাকা সফরে দু'দেশের কূটনৈতিক প্রোটোকলে মুক্তিযোদ্ধাদের মরদেহ সম্মানের সঙ্গে স্থানান্তরিত করার ইস্যুটি অন্তর্ভুক্ত ছিল৷
গতমাসে কর্নেল সাজ্জাদ ভারতে আসেন চার সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে৷ দেখা করেন ভারতের স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে৷ কর্নেল সাজ্জাদের দেয়া রিপোর্টের সত্যতা রাজ্য সরকার বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা সরকারের রিপোর্টের সঙ্গে যাচাই করার পর, ভারত তা মেনে নেয়৷ কর্নেল সাজ্জাদের কথায়, ‘‘সবাই যখন বুঝলেন এটা একটা জাতীয় কর্তব্য, মুক্তিযুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও বন্ধনের একটা টার্নিং পয়েন্ট, তখন কাজ হলো৷ আজ অনেকের মধ্যে সেই উদ্দীপনা দেখছি৷ অনেক সহযোগিতা পাচ্ছি৷''
প্রসঙ্গত, প্রতিনিধিদলটি পরে যায় পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ে৷ কর্নেল সাজ্জাদ জানান, ‘‘চারটি রাজ্য থেকে সিনিয়ার নোডাল অফিসার নিয়োগ করা হচ্ছে৷ তাঁরা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করবেন৷ কবরগুলো চিহ্নিত করার এবং দেহাবশেষ স্থানান্তরিত করার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবেন৷''
লেঃ কর্নেল নিজে যেহেতু যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন, তাই কিছু কবর তিনি নিজেই চিহ্নিত করে তার তালিকা ভারতকে দিয়েছেন৷ উল্লেখ্য, তিনি স্বয়ং বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কবর চিহ্নিত করে তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে গেছেন৷
বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে দু'দেশের বাঙ্গালি আবেগই শুধু নয়, জড়িয়ে আছে দেশপ্রেম এবং মানবিক অনুভূতি, যা হবে মুক্তিযুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের সহযোগিতার এক ঐতিহাসিক দলিল৷
প্রতিবেদন: অনিল চট্টোপাধ্যায়, নতুন দিল্লি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ