প্রথম লোকপাল হলেন এক বাঙালি
২০ মার্চ ২০১৯দীর্ঘ টালবাহানার পর অবশেষে সাধারণ নির্বাচনের মুখে যুগান্তকারী এক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত সরকার৷ ছয় দশক আগে দেশে দুর্নীতি-বিরোধী সর্বোচ্চ সংস্থা ও পদাধিকারী ‘লোকপাল' নিয়োগের দাবি উঠেছিল৷ সেই থেকে তর্ক-বিতর্ক চলছেই৷ ২০১১ সালে লোকপালের দাবিতে অনশনে বসে পুনরায় দেশজুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন প্রবীন সমাজসেবী আন্না হাজারে ৷ তার জেরে পূর্বতন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ২০১৩ সালে সংসদে লোকপাল বিল পাশ করায়৷ কিন্তু তাতেও জট কাটেনি৷ ২০১৪ সালের গোড়ায় লোকপাল ও লোকায়ুক্ত আইন কার্যকর হয়৷ কিন্তু লোকপাল হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি৷‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' স্লোগান দিয়ে ক্ষমতা দখলকারী নরেন্দ্র মোদী সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল৷
আদালতে বিচারপতি পিনাকী চন্দ্র ঘোষকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সৌম্য চক্রবর্তী৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বললেন, ‘‘ভারতের স্বাধীনতার পর এই প্রথম লোকপাল নিয়োগ হচ্ছে৷ একজন বাঙালিকে লোকপাল হিসেবে বেছে নেওয়ার ঘটনা বাঙালি হিসেবে বড় আশার কথা৷ ১৯৮৮ সাল থেকে ওঁকে চিনি৷ একসঙ্গে ওকালতি করেছি৷ অসাধারণ ভালো মনের মানুষ৷ পরোপকারী হিসেবে সুনাম আছে ওঁর৷ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতি ওঁর দুর্বলতা রয়েছে৷ ওঁর পূর্বপুরুষ রামকৃষ্ণের ব্যক্তিগত সান্নিধ্য পেয়েছেন৷ বিচারপতি হিসেবে বহু মামলায় মনে রাখার মতো রায় দিয়েছেন৷ বিচারপতি হিসেবে অবসর নেওয়ার পর মানবাধিকার কমিশনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি৷''
দুর্নীতি-বিরোধী সর্বোচ্চ সংস্থার শীর্ষ পদে বসছেন এক বঙ্গসন্তান৷ দেশের প্রথম লোকপাল চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পিনাকী চন্দ্র ঘোষ৷ আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সরকারি ঘোষণার পর পদের দায়িত্ব বুঝে নেবেন বিচারপতি ঘোষ৷ উনি ছাড়াও লোকপালের অন্যান্য ‘জুডিশিয়াল' সদস্যরা হলেন বিচারপতি দিলীপ বি ভোঁসলে, বিচারপতি প্রদীপ কুমার মোহান্তি, বিচারপতি অভিলাষা কুমারী ও বিচারপতি এ কে ত্রিপাঠী৷ আর ‘নন জুডিশিয়াল' সদস্য হিসেবে থাকছেন – দিনেশ কুমার জৈন, অর্চনা রামাসুন্দরম, মহেন্দর সিং ও ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ গৌতম৷ এঁরা প্রত্যেকেই লোকপালের প্রাক্তন আমলা৷
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ‘লোকপাল নির্বাচন কমিটি' এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ ‘অনুসন্ধান কমিটি'-র পাঠানো নামের তালিকা থেকে বেছে নেওয়া হয়েছে বাঙালি বিচারপতির নাম৷ মোদী ছাড়াও কমিটির সদস্যরা হলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন, প্রবীণ আইনজীবী মুকুল রোহতগি এবং লোকসভার কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে৷ যদিও ‘আমন্ত্রিত সদস্য' হিসেবে ডাক পাওয়ায় বৈঠক বয়কট করেন খাড়গে৷ কিছুদিন আগে লোকপাল বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা করে জানতে চাওয়া হয় লোকপালের নাম চূড়ান্ত করা হচ্ছে না কেন? অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল আদালতকে জানান, লোকপাল হিসেবে নির্বাচন কমিটির কাছে তিনজনের নামের তালিকা পাঠিয়েছে সার্চ কমিটি৷
এখন লোকসভা নির্বাচনের ঠিক মুখে লোকপাল নিয়োগে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদায়ী মোদী সরকার৷ ভারতের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকারের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল৷ এবার থেকে কেন্দ্রীয় লোকপালে প্রধানমন্ত্রীসহ যাবতীয় মহলের দুর্নীতির অভিযোগ জানানো যাবে৷ একইভাবে রাজ্যস্তরেও গঠন হবে লোকায়ুক্ত৷ যাবতীয় দুর্নীতির তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে লোকপাল৷ তবে সরকারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা, সরকারের বিদেশনীতি, পরমাণু শক্তি, মহাকাশ গবেষণা এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে কোনো তদন্ত করতে পারবে না লোকপাল৷ কেউ কেউ বলছেন, তাহলে লোকপালে লাভ কী? যাঁর আন্দোলনের ফসল এই লোকপাল, সেই সমাজসেবী আন্না হাজারে বলছেন, ‘‘প্রথম লোকপাল নিয়োগের সিদ্ধান্তে আমি খুশি৷ দীর্ঘ ৪৮ বছর ধরে জনগণের আন্দোলন সফল হতে চলেছে৷ লোকপালকে স্বাগত৷''
কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী শীর্ষেন্দু সিংহরায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘১৯৬০ সালে প্রথম লোকপালের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এক বাঙালি বিচারপতি অশোক কুমার সেন৷ এতবছর পর লোকপালের শীর্ষে বসছেন আরেক বাঙালি৷ বাঙালি হিসেবে আমরা গর্বিত৷ লোকপালের অর্থ জনতার রক্ষক৷ যাঁর কাছে প্রধানমন্ত্রীসহ সবার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জানানো যাবে৷ দীর্ঘদিনের আন্দোলন চলছিল৷ আজ সেই অন্দোলন সফল হলো৷''
পিনাকী চন্দ্র ঘোষের পরিচয়
তাঁর বাবা ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি শম্ভু চন্দ্র ঘোষ৷ জন্ম ১৯৫২ সালের ২৮ মে, গোয়াবাগানে৷ পি সি ঘোষের এখন বয়স ৬৬ বছর৷ তিনি ১৯৯৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন৷ পরে অন্ধ্রপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হন৷ তারপর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন৷ ২০১৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন৷ বর্তমানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অন্যতম সদস্য৷ তিনি তাঁর বেশকিছু রায়ের কারণেও বিখ্যাত৷ তামিলনাডুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ শশীকলাকে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন এই বিচারপতি৷ পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদলের অন্যতম ঘটনা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম নিয়ে মামলাতেও তাঁর রায় উল্লেখযোগ্য৷ ২০১২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ আইনকে ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক' বলে রায় দিয়েছিলেন তিনি৷ নন্দীগ্রামে গুলিচালনার ঘটনাকেও অসাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল তাঁর বেঞ্চ৷ তার আগে কলকাতা থেকে ১৫ বছরের পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির রায় চিরকাল মনে রাখবেন পরিবেশপ্রেমীরা৷ এখন তাঁর ঠিকানা কলকাতার রামময় রোড৷