ভারতে গরু'র পর এবার ময়ূর নিয়ে বিতর্ক
৫ জুন ২০১৭তিনি আরও বলেছেন, ‘‘তার অশ্রুজল পান করেই গর্ভবতী হয় ময়ূরী৷ তাই সে জাতীয় পাখি৷''
গরুর পরে এবার চোখ পড়েছে ময়ূরে৷ এবার বিতর্কের নয়া বিষয় ময়ূরের যৌন মিলন৷ তবে, বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে গরু ইস্যুতেই৷ গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করার সুপারিশ করতে গিয়ে ময়ূরের মিলনের প্রসঙ্গ তুলে আনেন রাজস্থান হাই কোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা৷ গবাদি মামলায় আগের দিন আদালতে রায় ঘোষণা করতে গিয়ে কেন্দ্র সরকারকে গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণার পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি৷ পরদিন তাঁর বিদায়ী সংবর্ধনা আনুষ্ঠানে রীতিমতো টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘আজীবন ব্রহ্মচারী থাকে ভারতের জাতীয় পাখি ময়ূর৷'' তাহলে প্রজনন কেমন করে হয়? মহেশচন্দ্রের জবাব, ‘‘ময়ূরীকে আকৃষ্ট করতে কাঁদতে থাকে ময়ূর৷ ময়ূরের কাছে এসে তার অশ্রুজল পান করে ময়ূরী৷ তারপর সে প্রেগন্যান্ট হয়৷''
রাজস্থান হাই কোর্টের বিচারপতি হিসেবে তাঁর কাজের শেষ দিনে তিনি কেন্দ্রকে পরামর্শ দেন, গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করা হোক এবং গো-হত্যায় দোষী সাব্যস্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেওয়া হোক৷ এখানেই ক্ষান্ত হননি৷ আদালতের বাইরেও এই নিয়ে সোচ্চার হন তিনি৷ গরুর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তুলে আনেন ময়ূর-ময়ূরীর যৌন মিলন বা সঙ্গমের প্রসঙ্গ৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই জানেন না, সারা জীবন ব্রহ্মচারী থাকে ময়ূর৷ তার চোখের জলের মাধ্যমেই সন্তানের জন্ম দেয় ময়ূরী৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণও ময়ূরের পালক মাথায় ধারণ করেছিলেন৷ আর গো-মাতার গায়ে ঠেস দিয়ে বাঁশি বাজাতেন শ্রীকৃষ্ণ৷''
এদিকে, মহেশচন্দ্রের এই তত্ত্ব প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনার ঝড় ওঠে সোশ্যাল মিডিয়ায়৷ রাজস্থান হাই কোর্টের বিচারপতির মন্তব্য নিয়ে মশকরা করতেও ছাড়েননি অনেকে৷ বিচারপতি নিয়োগের আগে প্রশিক্ষণের সময় চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়ে পশু-জন্তুর যৌন মিলনের ব্যাখ্যা বুঝিয়ে দেওয়া হোক, এমন পরামর্শও দিয়েছেন কেউ কেউ৷
হিঙ্গোনিয়া গোশালা মামলার শুনানিতে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি মহেশচন্দ্র৷ গত বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত অসুস্থতা এবং অন্যান্য কারণে ওই গো-শালায় মারা গিয়েছিল ৮০০০ গরু৷ সেই নিয়েই মামলা চলছে হাইকোর্টে৷ মামলার পর্যবেক্ষণে গরুকে দেশের জাতীয় পশু করা এবং গরু হত্যায় যারা দোষী সাব্যস্ত হবেন, তাদের যাবজ্জীবন কারাবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়৷ কেন্দ্রের কাছে রাজস্থান হাইকোর্টের এই প্রস্তাবের আগেই গরু ও মোষের মাংস বিক্রির উপর কেন্দ্র যে স্থগিতাদেশ জারি করেছে, তার উপর চার সপ্তাহের স্থগিতাদেশ জারি করেছে দেশেরই অন্য একটি আদালত৷ মাদ্রাজ হাইকোর্টের মাদুরাই বেঞ্চ৷ কেন সরকারের নির্দেশ বাতিল করে দেওয়া হবে না? নরেন্দ্র মোদীর সরকারের কাছ থেকে তা-ও জানতে চেয়েছে আদালত৷ দেশের বিভিন্ন রাজ্যেও কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ৷
আইনজীবী মহলেও বিচারপতির এই মন্তব্যকে নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছে। কেউ বলছেন, এরপর আর বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে তো? কেউ বলছেন, বিচারপতিদের নিয়োগ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৌম্য চক্রবর্তী কয়েক দশক ধরে এ পেশায় রয়েছেন৷ তিনি মনে করেন, বিচারপতি কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং অন্ধবিশ্বাসী একজন ব্যক্তি৷ ভারতের আইনের বাইরে গিয়ে এবং মূল মামলা থেকে সরে গিয়ে বিচারপতির এমন মন্তব্য বিচারব্যবস্থার ওপর কু-প্রভাব ফেলবে৷ এই ধরণের কথার কোনও মূল্য নেই৷ তাছাড়া যে পাখি সম্পর্কে এইসব বলেছেন, সেই পাখি সম্পর্কে তাঁর কোনও ধ্যানধারণা নেই বলেও মনে করেন তিনি৷ সম্প্রতি বিচারপতি কারনানের কর্মকান্ড এবং শেষমেশ এই বিচারপতির মন্তব্য প্রসঙ্গে ভারতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অভিজ্ঞ আইনজীবী
বিচারপতি শর্মা যাই বলুন না কেন , তাঁর কথায় মোটেই আস্থা নেই দেশএর নামী অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের৷ তাঁরা একে ‘গিমিক' বলেছেন৷ মহেশচন্দ্রের তীব্র সমালোচনা করে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ কে গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এক জন বিচারপতি এমনটা বলছেন, মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া বিজ্ঞানগত ভাবে ঠিকও নয়৷'' গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণা করার সুপারিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘বিচারপতি ব্যক্তিগত মত দিতেই পারেন৷ তবে, জাতীয় পশু করে দিলেই গরু বাঁচানো যাবে না৷ গো-হত্যা রোখার এটা সঠিক পদ্ধতি নয়৷ আবেগের পরিবর্তে বাস্তব দিয়ে কাজ করতে হবে৷' রাজস্থানের বিচারপতিকে তুলোধনা করেছেন দিল্লি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর এস লোধাও৷ তিনি বলেছেন, ‘‘জানতাম শুধুমাত্র নেতারাই গিমিকে বিশ্বাস করেন৷ এখন দেখছি অন্যরাও করেন ! সব কিছুর মধ্যে একটা ভাবনা-চিন্তা থাকতে হবে তো ! এই বিচারপতি নির্ঘাত কলেজিয়াম ব্যবস্থার ফল৷'' বিচারপতি শর্মার ময়ূর -মন্তব্য নিয়ে একপ্রস্থ ঠাট্টাও করেন তিনি৷ তাঁর মন্তব্য, ‘ময়ূরীদের কথা ভেবে খারাপ লাগছে৷ বেচারিদের কোনও যৌনজীবনই নেই ! আর দেশের সব ময়ূরই যৌনমিলনে অক্ষম৷ আগে তো জানতাম ময়ূরীদের আকর্ষণ করার জন্য ময়ূর পেখম তুলে নাচে, এখন দেখছি সবই চোখের জল দেওয়ার জন্য !''
আর যাঁকে ঘিরে এত বিতর্ক সেই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আজও বলছেন, তিনি কোনও ভুল বলেননি। পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থ নাকি তাঁর কাছে শিরোধার্য।