কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা দিল্লিতে সর্বোচ্চ
২৩ ডিসেম্বর ২০১৭দেশের ১৯টি মহানগরীর মধ্যে কম বয়সি অপরাধীদের সংখ্যা রাজধানী দিল্লিতেই সবচেয়ে বেশি৷ এরপর দ্বিতীয়স্থানে আছে মুম্বই৷ ২০১৫ সালের তুলনায় গত বছর অপরাধমূলক কাজকর্মের সঙ্গে জড়িত অল্পবয়সিদের সার্বিক হার বেড়েছে ২০ শতাংশ৷ ২০১৬ সালে দিল্লি ও তার আশেপাশের এলাকায় ২৩৬৮টি অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত মোট ৪৬৭৯ জন কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ দিল্লিতে এরা ১৪৩টি ধর্ষণ, ৩৫টি অস্বাভাবিক যৌন ক্রিয়া এবং যৌন হেনস্থা, মেয়েদের পিছু নেওয়া ইত্যাদির মতো ১৩৮টি যৌন অপরাধমূলক কাজকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ৷ এছাড়া ৫১টি খুন, ৮১টি খুনের চেষ্টা করার অভিযোগেও মামলা দায়ের করা হয় কিশোরদের বিরুদ্ধে৷ প্রতি বছরই এই হার যেভাবে বাড়ছে, তাতে দিল্লি পুলিশ এবং প্রশাসনিক মহলের চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া৷ এইসব অপরাধমূলক কাজকর্মের পেছনে এক বড় ভূমিকা আছে ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারের মতো সোশ্যাল মিডিয়ার, এমনটাই মনে করেন পুলিশ প্রশাসনের বড় কর্তারা৷
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও মারফত তুলে ধরা হয় ভোগবিলাসী জীবনযাপনের ছবি৷ সঙ্গে সঙ্গে তা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে৷ অপরাধ জগতের দিকে পা বাড়াতে সহজেই আকৃষ্ট হয় কিশোররা৷ আর সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগানোর পেছনে সক্রিয় থাকে কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের দল৷ এ সমস্ত গ্যাংস্টার ধরা পড়েও জামিন পেয়ে যায়৷ এরা প্রচুর টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে এবং মাদক খাইয়ে অল্পবয়সিদের অপরাধমূলক কাজে লাগায়৷ জালে জড়িয়ে পড়ার পর কিশোররা চায় পাড়ার মস্তান হয়ে উঠতে৷ তারা হাত পাকায় খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, মুক্তিপণ ইত্যাদির মতো অপরাধে৷
দিল্লি এয়ারপোর্টে নিযুক্ত নারী নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিশেষ পুলিশ কমিশনার সঞ্জয় বেনিওয়াল বলেন, কিশোর অপরাধীদের বেশিরভাগ উঠে এসেছে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে৷ এইসব কিশোরদের একটা বড় অংশ স্কুল ছুট (স্কুল ড্রপ-আউট) এবং মাদকাসক্ত৷ তাই সহজে টাকা রোজগারই এর আসল কারণ৷ জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রিপোর্ট বলছে, ২০১৬ সালে ধরা পড়া ৪৬৭৯ জন কিশোরের মধ্যে ৩৫৩৬ জন স্কুল ড্রপ-আউট এবং ২৯৭৭ জন কিশোর তাঁদের পরিবারের সঙ্গেই থাকে৷ তিনি মনে করেন, পুলিশি ব্যবস্থাই এই ভয়ংকর সামাজিক অপরাধের একমাত্র প্রতিষেধক নয়৷ সমানভবে এগিয়ে আসতে হবে গোটা সমাজকে৷ কিশোর মন ভঙ্গুর৷ সহজ শিকার৷ তাই দরকার পারিবারিক এবং পারিপাশ্বিক সুস্থ পরিবেশ৷ অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে বাবা-মা কিংবা অভিভাবকরা বাচ্চাদের চরিত্র গঠনের দিকে তেমন নজর দেন না৷ মা-বাবা দু'জনকেই রোজগারের ধান্দায় কাজে বেরিয়ে যান৷ এদের মধ্যে আছে দিন মজুর৷
গত অক্টোবরের ঘটনা৷ দিল্লির লাগোয়া হরিয়ানায় দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া একজন ভালো ছাত্রকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ ছাত্রটির বাবা জানান, একদিন কোচিং পড়তে গিয়ে ছেলে তাঁর বাড়িতে ফেরেনি৷ পুলিশের কাছে সে নাকি স্বীকার করে যে এলাকার এক কুখ্যাত গ্যাংস্টারদের পাল্লায় পড়ে সে৷ তারা ওর মগজ ধোলাই করার পর ওকে দিয়ে একজনকে খুন করায় এটা প্রমাণ করতে যে, ঐ এলাকার মস্তান হয়ে ওঠার যোগ্যতা ওর আছে৷ দ্বিতীয়ত, পুলিশের মতে গুণ্ডাচক্র কম বয়সিদের বেছে বেছে দলে ঢোকায়৷ কারণ কিশোররা নাকি অপরাধমূলক কাজটা করতে পারে দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে এবং তাদের বিচারের সন্মুখীন হতে হয় না নাবালক বলে৷ বড়জোর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংশোধনাগারে৷ যেমন ২০১২ সালের ৬ই ডিসেম্বর দিল্লির নির্ভয়া গণধর্ষণ এবং খুনের ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত একজন কম বয়সি ছেলের কোনো সাজা হয়নি৷ যেহেতু ঐ সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছরের ছয় মাস কম৷ আজও সে সংশোধনাগারে আছে৷ হালে হরিয়ানার একটি নাম-করা স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়া এক ছাত্র ঐ স্কুলেরই দ্বিতীয় শ্রেণির একটি বাচ্চাকে স্কুলের বাথরুমে গলা কেটে খুন করে৷ ছাত্রটিকে গ্রেপ্তার করা হয় এখন বিচার চলছে৷ এর প্রেক্ষিতে, অতি সম্প্রতি জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড রায় দেন নির্ভয়া কাণ্ডের মতো জঘন্য অপরাধে নাবালকদের অর্থাত ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সি অপরাধীদেরও বিচার হবে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো৷
কিশোর বা নব্য যুবকরা কেন অপরাধ জগতের দিকে পা বাড়ায় তার মনস্তাত্ত্বিক কারণ ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখ্যা করলেন বিশিষ্ট মনোরোগী চিকিত্সক ডা. আশিষ আচার্য৷ কিশোর অপরাধীদের সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গেছে এ কথাটা উনি মানতে পারলেন না৷ বললেন, আগেও হতো৷ কিন্তু মিডিয়া রিপোর্ট করতে পারতো না বলে হয়ত চাপা থাকতো৷ এখন মিডিয়া সব ঘটনা তুলে ধরছে৷ তাই নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না যে সংখ্যাটা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে৷ তবে অল্পবয়সিদের অপরাধ প্রবণতা মূল কারণ ভোগ্যপণ্য-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা৷ এখনকার নব্য যুব সমাজ বা কিশোর সমাজ যে কোনো জিনিস এখুনি পেতে চায়৷ অপেক্ষা করতে চায় না৷ আগেকার দিনে কাঙ্খিত বস্তু পেতে আমরা উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষা করতাম৷ দ্বিতীয়ত, সংসারে বাবা-মা রোল মডেল – এই সিস্টেমটার বর্তমানে বড় অভাব৷ এক তো পরমাণু পরিবার৷ বাবা-মায়ের মধ্যে মিল নেই৷ পরিবারে হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশ কম৷ মদ্যপান বা পারিবারিক হিংসা ইত্যাদি চোখের সামনে ঘটছে৷ শৈশব ও কৈশোর যদি মসৃণভাবে না হয়, যেমন শিক্ষা-দীক্ষা-সঙ্গ ঠিকমতো না পায়, তবে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে৷
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেনেটিক ত্রুটির কারণে সমাজ বিরোধী হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা থেকে যায়, যেটাকে বলে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার৷ যেমন হিংস্রভাবে কাউকে মারা৷ দ্বিতীয়ত, যৌন বাসনা চরিতার্থ করার সুযোগ না পাওয়া৷ অথচ ওরা চোখের সামনে দেখছে ওরই বয়সি অন্যরা পার্টি করছে, মেয়েবন্ধুদের সঙ্গ পাচ্ছে, মেলামেশা করছে৷ একটা বঞ্চিতভাব থেকেই ঐ সব কিশোর বয়সিরা ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদির মতো অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে৷
কিশোরদের অপরাধপ্রবণতার কারণ কী? লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷