ভারতে কিডনি বেচাকেনার অবৈধ ব্যবসা
৮ অক্টোবর ২০১৭প্রতিস্থাপনের জন্য ভারতে বছরে যেখানে দুই লাখেরও বেশি মানুষের নতুন কিডনির দরকার হয়, সেখানে পাওয়া যায় বড়জোর আট হাজারের মতো কিডনি৷ চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ব্যবধান এত বেশি হওয়ায় কিডনি, লিভার হার্ট ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লাভজনক অবৈধ ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠছে৷ চলছে লাখ লাখ টাকার খেলা৷ কিডনি অপারেশনে সাধারণত খরচ পড়ে গড়ে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা৷ কিডনি পাচারকারীরা প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে অতি গরিব পরিবার এবং দিন আনে দিন খায় এমন ‘অশিক্ষিত' লোকদের টার্গট করে৷ তাঁদের নানাভাবে মগজ ধোলাই করে৷ বোঝায়, মানুষের দুটো কিডনির একটা দিলে তাঁর কোনো ক্ষতি হয় না৷ কয়েকদিনের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে৷ অপারেশন হবে শহরের বড় বড় সব হাসপাতালে৷ এজন্য সে পেয়ে যাবে একসঙ্গে তিন-চার লাখ টাকা৷ লোভ সামলাতে পারে না বেচারা গরিব পরিবার, রাজি হয়ে যায়৷
কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ করার মতো দেশে অনেক রোগী আছে৷ এছাড়া ইউরোপ, অ্যামেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলো থেকে আসেন অনেক শাঁসালো গ্রহীতা৷ এই তো গত বুধবার ভারতের দক্ষিণী রাজ্য তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার এআইএডিএমকে দলের বিতর্কিত নেত্রী শশিকলার স্বামী নটরাজনের কিডনি ও লিভার প্রতিস্থাপন অপারেশন হয় চেন্নাই-এর এক বেসরকারি হাসপাতালে৷ অভিযোগ ওঠে, অন্য শহর থেকে এক ব্যক্তিকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উড়িয়ে আনা হয় এবং হাসপাতালে তাঁকে ব্রেন-ডেড ঘোষণা করা হয়৷ তাঁর অঙ্গ কিভাবে দান করা হয় এবং কত টাকা খরচ করা হয়, দাতার পরিবারকে কত টাকা দেওয়া হয় এইসব বিষয়ে তদন্তের দাবি জানায় রাজ্যের বিজেপি সভাপতি৷ অভিযোগ ওঠে, অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বাণিজ্যিকভাবে এটা করে৷ সরকারি হাসপাতালগুলিতে এই অঙ্গ প্রতিস্থাপন অপারেশন সাধারণত হয় না বললেই চলে৷ কেন ? কারণ, সেখানে ব্যবসাটা ঠিকমতো জমে না, তাই৷
প্রতিস্থাপনের জন্য কিডনি বা অঙ্গ পাচার রোধে কঠোর আইন রয়েছে ভারতে৷ সেই আইনের চোখে ধুলো দিতে তৈরি করা হয় ভুয়ো কাগজপত্র৷ যেমন জাল ভোটার পরিচয়পত্র, জন্মের তারিখ এবং স্কুলের সার্টিফিকেট, ব্যাঙ্কের পাসবুক ইত্যাদি৷ সেইসব জাল কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ করা হয় কিডনির দাতা ও গ্রহীতা পরস্পরের আত্মীয়-পরিজন৷ কারণ, নিকট আত্মীয় ছাড়া অঙ্গদান নিষিদ্ধ৷ আইন অনুসারে কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিডনি দিতে চান শ্রদ্ধা বা ভালবাসার টানে বা দয়া পরবশ হয়ে, সেটা ব্যতিক্রম বলে ধরা হবে৷ কিন্তু তাতে টাকার প্রশ্ন থাকবে না৷ যেমন, এই কিছুদিন আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুষমা স্বরাজের কিডনির সফল প্রতিস্থাপন হয়৷ কিডনি যিনি দেন, তিনি তাঁর পরিবারের কেউ নন৷ কিন্তু তাঁর শুভানুধ্যায়ী৷
গত বছর জুন মাসে পুলিশ তিনটি বড় কিডনি পাচার চক্রের হদিস পায়, গ্রেপ্তার করা হয় ১৩ জনকে৷ সবচেয়ে বিস্ময়কর এই পাচার চক্রের মূল পান্ডা ৬৫ বছর বয়সি একজন ডাক্তার, নাম অমিত কুমার৷ একের পর এক বহু লোকের কিডনি অপারেশন করেছেন তিনি নাম ভাঁড়িয়ে৷ এক শহর থেকে অন্য শহরে গিয়ে৷ মোটা টাকার বিনিময়ে৷ ধরা পড়লে সহজেই জামিন পেয়ে যান৷ ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন অবৈধ কিডনি অপারেশনে পাচার চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে৷ প্রথমে শুরু করেছিলেন মুম্বাইয়ে৷ তারপর দিল্লিতে৷ সেখান থেকে হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রের অন্য অঞ্চলে৷
কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা এত বাড়ছে কেন? নেফ্রোলজিস্টদের মতে, এর মূল কারণ ডায়বেটিস, মানসিক চাপ এবং লাইফ স্টাইল৷ মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে৷ কম বয়সেই কিডনি আক্রান্ত হচ্ছে, অকেজো হয়ে পড়ছে৷ এখন কিডনি প্রতিস্থাপনের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গড় বয়স সাধারণত ৫০ বছরের নীচে, বললেন দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সের নেফ্রোলজিস্ট ড. সন্দীপ মহাজন৷ ভারতে প্রতি বছর দেড়-দু' লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়৷ তাঁদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ব্রেন-ডেড৷ এইসব ক্ষেত্রে যদি তাঁদের দুটো কিডনি উদ্ধার করা যায়, তাহলে বহু লোকের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷