ভারতে কন্যাভ্রূণ হত্যা অব্যাহত
৩০ মার্চ ২০১৪তাহলে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারের উদ্বেগ কি মেকি নয়?
দেশের আইন বলছে, লিঙ্গ নির্ধারণ বা কন্যাভ্রূণ হত্যা করলে বা সদ্যোজাত কন্যাসন্তান পরিত্যাগ করলে কিংবা অবৈধ গর্ভপাত করা হলে কড়া সাজা হবে ডাক্তার বা রেডিওলজিস্টের৷ এ জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় শাস্তির সংস্থান আছে৷ সেই ধারায় ক'টা অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে? যদি হতো, তাহলে অন্তত এক কোটি মানুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা যেত৷ ‘লিঙ্গ সমতা ও উন্নয়ন' সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, গত দুই দশক ধরে ভারতে বছরে প্রায় আড়াই লাখ কন্যাভ্রূণ হত্যা করা হয়েছে৷ এই পরিসংখ্যানে সমাজের মাথা হেঁট হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় সমাজ চোখ বুজে না থাকলে এটা কি সম্ভব হতো? পশ্চিমবঙ্গের জনৈক স্বাস্থ্য অধিকর্তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন, যে দেশে ব্যাপক হারে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ চলেছে৷ প্রি-ন্যাটাল ডায়গনস্টিক পদ্ধতিতে যদি দেখা যায় কন্যাভ্রূণ, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই ভ্রূণহত্যা করা হয়৷ পরিণামে গোটা দেশে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের অনুপাত কমে যাচ্ছে৷ প্রতি হাজার পুরুষে মেয়েদের গড় সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১৪৷
ভারতে নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এবং লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কত আন্দোলন, প্রতিবাদ, মিছিল, আলোচনাচক্র লাগাতার চলেছে, কিন্তু তাতে ভেতরের ছবিটা পালটায়নি আদৌ৷ সব যেন প্রহসন বলে মনে হয়৷ ২০১৩ সালের মানব উন্নয়ন রিপোর্টে বলা হয়, কন্যা সন্তানরা শিশুকাল থেকেই অপুষ্টির শিকার হয় বেশি৷ ফলে তাঁরা যখন মা হন, তখন তাঁদের অপুষ্টির ফল ভোগ করতে হয় সন্তানদের৷ ভারতে প্রায় ৪২.৫ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে৷ মেয়েদের পুষ্টিহীনতা অনেক বেশি হয়, কারণ খাওয়াপরা ও যত্ন পরিচর্যার দিক থেকে পুত্রসন্তানদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়৷ ছোটবেলা থেকে মেয়েদের ভাবতে শেখানো হয়, ছেলেরা সংসারের সম্পদ৷ প্রায় ৫৪ শতাংশ শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ হয়না৷ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় অনেক আগেই৷
এখানেই শেষ নয়, কন্যা সন্তানদের ওপর দৈহিক নির্যাতন ও যৌন নিগ্রহের পরিধি ব্যাপক৷ শিশু নিগ্রহ সংক্রান্ত জাতীয় সমীক্ষা বলছে ৫৩ শতাংশ কন্যা সন্তান কোনো না কোনো যৌন নিগ্রহের শিকার বাল্য বয়স থেকেই এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা হয় তাঁদের পরিচিতজন বা আত্মীয়দের দ্বারা৷ শিশু যখন নারী হয়ে ওঠে, তখনো এটা চলতে থাকে৷ জাতীয় অপরাধ ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১২ সালে প্রায় ২৫ হাজার ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়৷ এর ৯৯ শতাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণকারী ধর্ষিতার পরিচিত৷ ঘরে মেয়েদের জন্য শৌচালয় না থাকায় রাতে তাঁদের যেতে হয় মাঠে বা ঝোপঝাড়ে৷ সেখানেও থাবা মারে ধর্ষকরা৷
মেয়েদের পারিবারিক ও সামাজিক শোষণের তালিকা দীর্ঘ৷ বিয়ের ব্যাপারে প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে পাঁচ জনের মত নেয়া হয়না, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৮ জনকে ডাক্তার দেখাতে হলে ঘরের অনুমতি নিতে হয়৷ সাবালিকা হবার আগেই বিয়ে হয়ে যায় মেয়েদের৷ ২৫ বছরের বেশি বয়সের মহিলাদের মধ্যে ৪৮ শতাংশ স্বীকার করে তাঁদের বিয়ে হয় প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে৷ মহিলাদের মধ্যে বিশেষ করে গরিব মহিলারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণ হারান৷ ভারতে বছরে দুই কোটি ৭০ লাখ শিশুর জন্মদান কালে অন্তত ৫৪ হাজার প্রসূতির মৃত্যু হয়৷
পৃথিবীর আলো দেখার আগে কন্যাভ্রূণ হত্যা থেকেই শুরু হয়ে যায় মেয়েদের প্রতি পাশবিকতা৷ কাগজে কলমে এর বিহিত করার সংস্থান থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগ হয়না বললেই চলে৷ শাস্তির বিধানই শেষকথা নয়৷ এর বিরুদ্ধে তৈরি করা দরকার ব্যাপক জনমত ও জনসচেতনতা৷ সেটা কে করবে, কী ভাবে করবে?