ভারতে ইসরায়েলের সাংস্কৃতিক-কূটনীতি
১৭ জুন ২০১৩এটা নেহাতই সমাপতন যে দুটি ঘটনা প্রায় একই সময়ে ঘটল৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেখানে প্রায়ই নির্যাতিত হচ্ছেন মহিলারা, লুণ্ঠিত হচ্ছে নারীর সম্মান এবং প্রশাসন কার্যত নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয়, সেখানে ইসরায়েলের একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কলকাতায় বলে দিয়ে গেল, নারী শক্তির জাগরণই ওই নির্যাতন ও সম্মানহানি ঠেকানোর একমাত্র পথ৷ আইসিসিআর অর্থাৎ ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস-এর কলকাতাস্থ রবীন্দ্রনাথ টেগোর সেন্টারের সত্যজিৎ রায় প্রেক্ষাগৃহে, ইসরায়েলি কোরিওগ্রাফার ও নৃত্যশিল্পীদের দল কিন্ডলিং সম্প্রতি যে অনুষ্ঠানটি করে গেল, তার মৌলিক ভাবনায় ছিল ভারতীয় নারী৷ এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য কিন্ডলিংয়ের শিল্পীরা গত দু'মাস কাটিয়েছেন হিমাচল প্রদেশে৷ সেখানে নারীদের সামাজিক অবস্থান এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তাদের ভূমিকা খুব কাছ থেকে দেখেছেন৷ সেই পর্যবেক্ষণের ফসল প্রায় দু'ঘণ্টার একটি নৃত্য-কোলাজ, ভারতীয় নারীর জীবনের কিছু খণ্ডমুহূর্তের নকশিকাঁথা৷
ইসরায়েলের বিশিষ্ট কোরিওগ্রাফার শাকেড ডাগান এই সাংস্কৃতিক প্রযোজনাটির ধাত্রী মা ছিলেন৷ শুধু ইসরায়েলি নৃত্যশৈলী নয়, পোলিশ, ডাচ এবং মার্কিন ঘরানার নাচও তার সঙ্গে মিশে আছে, ভারতে যার সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে কত্থক৷ শাকেড ডাগান বললেন, ইসরায়েল যুদ্ধ চায় না৷ বিশ্বজুড়ে শান্তি চায়৷ আর চায় আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক মৈত্রী৷ সেই বার্তা দিতেই তাঁরা কলকাতায় এসেছেন ঠিক সেই সময়ে, যখন ভারতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলেন উশপিজ কলকাতায় এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কিছু বাণিজ্যিক ও কারিগরি সহায়তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা করতে৷ লক্ষণীয়, একদিকে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক বার্তা নারীশক্তির জাগরণের, অন্যদিকে কৃষিপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের জন্য ইসরায়েলি প্রস্তাব, কৃষিপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতার৷ রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মলয় ঘটকের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলোচনায় ঠিক হয়েছে, এই রাজ্যের কৃষকদের স্বভাবজাত দক্ষতার সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটাবেন ইসরায়েলি কৃষি বিশেষজ্ঞরা৷
উল্লেখ্য, বিশ্বের অনেক জায়গাতেই আজকাল ইসরায়েলের কৃষি মডেল অনুসরণ করা হয়, যেখানে কৃষিকাজে জলের জোগান কম লাগে বা সবজি চাষে টিশু কালচার পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়৷ ভারতেও এর আগে হরিয়ানা, রাজস্থান, কর্নাটক, তামিলনাড়ুতে এই ইসরায়েলি পদ্ধতির চাষ শুরু হয়েছে৷ এবার পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে সারা পূর্ব ভারতেই এই পদ্ধতিকে সুলভ ও জনপ্রিয় করে তোলা হবে৷ ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত আলেন উশপিজ এর আগেও একবার পশ্চিমবঙ্গে এসে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিলেন৷ সেইসময় মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রস্তাব দেন, এই রাজ্যে যৌথ উদ্যোগে একটি কৃষি উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ার জন্য৷ সেই প্রাথমিক আলোচনাটিই এবার চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে৷ কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, হুগলির আদি সপ্তগ্রামে দু'একর জমি দেবে সরকার, যেখানে সরকারি কৃষিখামারটিকে উৎকর্ষ কেন্দ্রের পর্যায়ে উন্নীত করা হবে৷
জানা গিয়েছে, এই কৃষি উৎকর্ষ কেন্দ্র নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট ইসরায়েল সরকারকে ইতোমধ্যেই পাঠানো হয়েছে৷ সেটি খতিয়ে দেখে কিছুদিনের মধ্যেই মতামত দেবে ইসরায়েল সরকার৷ অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সুগন্ধী বাসমতী চাল রপ্তানি নিয়েও ইসরায়েলের সঙ্গে কথা হয়েছে৷ এ ছাড়া কিছু মরশুমি রসাল ফল, যেমন আম, লিচু, আনারস নিয়মিত রপ্তানির প্রস্তাবও রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ইসরায়েলকে দেওয়া হয়েছে৷ ইসরায়েল বলেছে, ১০ দিনের মধ্যে ফলগুলির নমুনা পাঠাতে৷
ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত ইশপিজ কলকাতার নারকেলডাঙায় ইহুদিদের যে সমাধিক্ষেত্র আছে, সেখানে গিয়ে সম্প্রতি প্রয়াত ডেভিড নাহুমের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানান৷ এই ডেভিড নাহুম ছিলেন কলকাতার নিউ মার্কেটের বিখ্যাত কেক-পেস্ট্রির দোকান, শতাব্দীপ্রাচীন নাহুমস-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এই শহরের ইহুদি সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের মতো৷ রাষ্ট্রদূত ইশপিজ বলেন, কলকাতায় বসবাসরত প্রবীণ ইহুদি পরিবারগুলি যে আদর-যত্ন এবং সম্মান পায় সহ-নাগরিকদের থেকে, বিশ্বের খুব কম জায়গাতেই তেমনটা হয়৷ উল্লেখ্য, কলকাতায় ইহুদি সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন কিছু ঐতিহ্যশালী প্রাচীন ভবনের সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণেও অর্থসাহায্য করে ইসরায়েল৷