বড়দিন নিয়ে অঘোষিত ফতোয়া!
২১ ডিসেম্বর ২০১৭ভারতে ক্রিসমাস পালন কি অপরাধ? দেশকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়া রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের কাজকর্মে এবং প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক পদক্ষেপে তাই মনে হচ্ছে৷ ক'দিন আগে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে ৩০০ মাইল উত্তর-পূর্বের জেলা সাতনায় গরিব হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার অভিযোগে থানার বাইরেই মারধর করা হয়েছে ১০ জন ক্যাথলিক যাজক-সহ বেশ কয়েকজন খ্রিষ্টানকে৷ তাঁদের গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অভিযোগের তীর বজরং দলের বিরুদ্ধে৷
অথচ প্রতিবছরই দেশের প্রায় আড়াই কোটি খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সাড়ম্বরে ২৫শে ডিসেম্বর যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিন পালন করে থাকেন৷ অনুষ্ঠানে অংশ নেন সব ধর্মের আরও কয়েক কোটি মানুষ৷ কিন্তু বিগত কয়েক বছরে দেশজুড়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের হাতে অন্যান্য ধর্মের মানুষদের নিগৃহিত হওয়ার ভুরি ভুরি অভিযোগ জমা পড়েছে৷ এক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা কার্যত নীরব দর্শক৷ ফলে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছে৷ এর আগে পোপ ফ্রান্সিসের ভারত সফর নিয়ে মোদী সরকার বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ সব মিলিয়ে বড়দিনের আগে খ্রিষ্টান যাজকদের উষ্মা আছড়ে পড়ছে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে৷
এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে সাতনার ঘটনাটি৷ ধর্ম যাজকদের মারধরকারী ও গাড়ি পোড়ানোর ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছে স্থানীয় পুলিশ৷ উলটে বজরং দলের অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন খ্রিষ্টান ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে ‘জোর করে ধর্মান্তকরণ'-এর অভিযোগে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় ৫০ জন খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেছে পুলিশ৷ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে৷
সর্ব ভারতীয় ক্যাথলিক বিশপ কনফারেন্স সংগঠনের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ফাদার যোশেফ মনিপদম ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘খ্রিষ্টানদের ওপর একের পর এক এই ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকায় সত্যিই চিন্তিত ভারতের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষরা৷ গতকাল ক্যাথলিক বিশপদের একটি প্রতিনিধি দল কেন্দ্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করেছে৷ কেন্দ্র সরকারের তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে মধ্যপ্রদেশের ঘটনার তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনত ব্যাবস্থা নেওয়া হবে৷ এছাড়া আলিগড়ে স্কুল ও ছাত্রছাত্রীদের বড়দিন পালনে কোনোরকম হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবে না সরকার৷
এই ধরনের ঘটনা ক্রমশ বাড়তে থাকায় নিন্দায় সরব হয়েছে ভারতের ক্যাথলিক বিশপ কনফারেন্স৷ তারা সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে৷ সর্বভারতীয় ক্যাথলিক বিশপ সংগঠনের সভাপতি কার্ডিনাল মার ব্যাসেলিওস ক্লিমিসের অভিযোগ, ‘‘ভারতে খ্রিষ্টান ও সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ বাড়ছে৷ কারণ প্রশাসনের উপর তাঁদের বিশ্বাস ক্রমশই কমে আসছে৷''
মধ্যপ্রদেশ ছাড়াও ভারতের আরও কয়েকটি জায়গায় যিশুর ছবি ও বাইবেল বিলিয়ে, কীর্তন গেয়ে হিন্দু গ্রামবাসীকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চলছে বলে কট্টরপন্থি হিন্দু গোষ্ঠীর তরফে অভিযোগ করা হচ্ছে৷ উত্তর প্রদেশের আলিগড়ের বেশ কয়েকটি ক্যাথলিক বিদ্যালয়ে ক্রিসমাস পালনকে ঘিরে আপত্তি জানিয়েছে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ৷ হিন্দুত্ববাদী এই সংগঠন বিভিন্ন স্কুলে রীতিমতো নোটিশ পাঠিয়ে নির্দেশ জারি করেছে, ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে হিন্দু শিসুদের স্কুলের কোনো উৎসবে সামিল করা চলবে না৷ এ ব্যাপারে সরকার, পুলিশ কেউই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
মঞ্চের সভাপতি সোনু সবিতা বলছেন, ‘‘ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে ভারতীয় হিন্দু শিশুদের মধ্যে খ্রিষ্টান সংস্কৃতি প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার এক অপচেষ্টা চলছে৷ এটা মেনে নেওয়া হবে না৷ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করছেন সান্টাক্লজের পোশাক, ক্রিসমাস ট্রি, কেক-চকোলেট-টফি কিনে নিয়ে যেতে!''
সাতনায় ধর্মেন্দ্র দোহার নামে স্থানীয় এক যুবক আবার অভিযোগ করেছেন যে, গত রবিবার নাকি তাঁকে অবৈধভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে৷ তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে যাজক এম জর্জসহ ছ'জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ৷ স্থানীয় সিভিল লাইন থানার সাব-ইন্সপেক্টর মোহিনী শর্মা জানান, ‘‘অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গাড়ি পোড়ানোর অভিযোগ দায়ের হয়েছে৷'' ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের লোকজনকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁর দাবি, ‘‘থানার বাইরে ক্যাথলিকদের মারধর করা হয়ে থাকলে যদি তাঁরা অভিযোগ দায়ের করেন, তাহলে পুলিশ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে৷''
সাতনার বিশপের অফিসের সমাজকল্যাণ বিভাগের ডিরেক্টর ফাদার এম রনি বলেছেন, ‘‘আমাদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল৷ গত ২০ বছর ধরে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়৷ অনুষ্ঠানে কাউকেই ধর্মান্তরিত করা হয়নি৷ দোহারকে চিনি না৷ যে অনুষ্ঠানকে ঘিরে বিতর্ক সেখানে ১০ জন যাজক এবং ৩২ জন শিক্ষানবিশ যাজক উপস্থিত ছিলেন৷''
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, ঘটনার দিন রাত ৯টা নাগাদ হঠাৎ কিছু লোক সেখানে হাজির হয়৷ আচমকাই গণ্ডগোল শুরু করে৷ তাদের অভিযোগ, ধর্মীয় সভার নামে জোর করে, ফুসলিয়ে দরিদ্র হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে৷ তারপর তারাই পুলিশে খবর দেয়৷ পুলিশ এসে ৩২ জন শিক্ষানবিশ যাজক ও দুই যাজককে থানায় নিয়ে যায়৷ সেখানে তাঁদের মারধর করে বজরং দলের লোকজন৷ খবর পেয়ে আরও কিছু যাজক থানায় গেলে তাঁদেরও মারধর করে গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়৷ ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যাথলিকদের ছেড়ে দেয় পুলিশ৷
সর্বশেষ মঙ্গলবার রাজস্থানের প্রতাপগড়ে বড়দিনের একটি অনুষ্ঠান বিঘ্নিত করে হিন্দুত্ববাদীরা৷ তাদের অভিযোগ, বড়দিনের নামে আসলে স্থানীয় গরিব হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করানো হচ্ছিল৷ পুলিশ ইতিমধ্যেই দু'জন খ্রিষ্টান মিশনারিকে আটক করেছে বলে খবর৷
প্রসঙ্গত, বিজেপি-শাসিত মধ্যপ্রদেশে ধর্ম পরিবর্তনের কড়া আইন আছে৷ ধর্মান্তরিত হওয়ার আগে স্থানীয় প্রশাসনকে আগাম চিঠি দিয়ে জানাতে হয়৷ তা না হলে ধর্মান্তকরণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ তবে সাতনার ঘটনায় শেষমেশ পিছু হটছে পুলিশ৷ তারা জানিয়েছে, যাজকদের আটক করা হলেও তাঁদের বিরুদ্ধে এখনই ধর্মান্তকরণ বিরোধী অভিযোগ আনা হচ্ছে না৷ তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷