বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকার আদায়ের এক শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে দীর্ঘকাল ব্যবহৃত হয়েছে হরতাল৷ স্বাধীন বাংলাদেশে একটা লম্বা সময় হরতালের ব্যবহার দেখা গেছে৷ বর্তমানে যে দল ক্ষমতায় তারা এখন যে দাবি মানতে নারাজ সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ২১ বার হরতাল পালন করেছে৷আবার ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকাকালে আওয়ামী লীগ সব মিলিয়ে ১৩০ দিন হরতাল করেছে।
অতীতে বিএনপিও হরতাল করেছে৷ এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও হরতালের অনেক ব্যবহার হয়েছে৷ আর সব আমলেই হরতাল চলাকালে ভাঙ্চুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকি প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে৷
তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে হরতালের ব্যবহার দেখা যায়নি৷ কিন্তু ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর আবারও ফিরেছে হরতাল৷ তবে সেটি আগের মতো অধিকার আদায়ের শক্তিশালী অস্ত্র আর আছে কিনা সেটা এক বড় প্রশ্ন এখন৷
নির্বাচন কভার করতে ঢাকায় আসার পর শনিবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে হরতাল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি৷ হরতালের আগের রাতেই একটি ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত চারজন প্রাণ হারিয়েছেন৷ ইতোমধ্যে বড় দলগুলো এই ঘটনাকে ‘‘নাশকতা'' বলে একে অপরকে দূষতে শুরু করেছে৷ বিরোধী দল বিএনপি কারা ট্রেনে আগুন দিয়েছে তা জানতে জাতিসংঘের সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে৷ পুলিশ তদন্ত করছে, যদিও সেই তদন্তের উপর বিরোধী দলের আস্থা আছে বলে মনে হচ্ছে না৷
শনিবার ঢাকায় হরতালের সময় যানজট ছিল না৷ সড়কগুলোয় সিএনজি আর কিছু প্রাইভেট গাড়ির বাইরে বাস বা বড় যানবাহন তেমন একটা দেখিনি৷ মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখেছি শত শত বাস পার্ক করে রাখা হয়েছে৷ যাত্রী বলতে গেলে নেই, তাই বাস স্বাভাবিক সময়ের মতো ছাড়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন বাস চালকরা৷
তবে, হরতালের দিনে ঢাকা শহরে পিকেটিং করতে দেখিনি কোথাও৷ বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ছোট ছোট সংখ্যায় হরতালের সমর্থনে মিছিল করেছে৷ সেগুলো অবশ্য রাজপথের তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা গেছে বেশি৷
দিনের শেষে মানবজমিন পত্রিকা একটি বার্তা দিয়েছে ফেসবুকে৷ বাংলাদেশ থেকে পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যাচ্ছে না৷ আমি নিজেও চেষ্টা করে দেখলাম ঘটনা সত্য৷ পত্রিকাটির দাবি, তাদের তরফ থেকে কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটা ঘটছে না৷
লেখার শুরুতে বলছিলাম বিএনপি অফিসের সামনের কথা৷ সেখানে দাঁড়িয়ে আপনমনে স্লোগান দিয়ে যাচ্ছেন নাসরিন আক্তার বিথি৷ বিএনপির সমর্থক তিনি৷ কথা বলার সময় গলা কাঁপছে তার, জীর্নশীর্ন দশা৷ তার দাবি, বিএনপি অফিস খুলে দেয়া হোক, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক৷
বিথির ভয়ডর কিছু আছে বলে মনে হলো না৷ বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির অধিকাংশ শীর্ষনেতা এখন কারাবন্দি৷ গত দুইমাসেই জেলে গেছে তাদের ২০ হাজারের বেশি কর্মী৷ এগুলো নতুন সংখ্যা৷ গত কয়েকবছর ধরেই অনেক বিএনপি নেতাকর্মীর দিন কাটে জেলে কিংবা কোর্টে৷ অনেকে আছেন আত্মগোপনে৷ এত দমনপীড়নের মুখে থাকা দলটির নেতাকর্মীরা খুব একটা রাজপথে বের হতে পারছেন না এখন৷
বিথিকে নিয়ে অবশ্য তেমন একটা ভাবিত নন কেউ৷ তার বক্তব্য, দাবি সবই সুস্পষ্ট৷ বিএনপি নেতাদের অনেকের নাম নিলেন তিনি, জানালেন তাদের সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা৷ কিন্তু কেউ কেউ পাশ থেকে বললেন, বিথি মানসিকভাবে অসুস্থ!
ভোটের আগের সন্ধ্যায় ঢাকার প্রেসক্লাবের সামনে দেখলাম ছোট্ট একটা জটলা৷ কক্সবাজারের রামু থেকে আসা তরুণ মো. লুৎফুর রহমান একটা কম্বল আর ব্যাগ নিয়ে বসে আছেন একটা পোস্টারের নিচে৷ তাতে লেখা, ‘‘আমরণ অনশন''৷ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে দাবিতে অনশন শুরু করেছেন তিনি৷ শনিবার ভোর চারটা থেকে তার এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে৷
তিনি এই ব্যক্তিগত কর্মসূচি কতক্ষণ চালিয়ে যেতে পারবেন তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ ইতোমধ্যে পুলিশ তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেছে৷
গত কয়েকদিন ঢাকা শহরে ঘুরে একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারছি৷ সেটা হচ্ছে, ভয়ের সংস্কৃতি৷ অনেকের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন ভয় দেখতে পাই৷ ক্যামেরার সামনে কথা বলতে চান না অনেকে৷ কেউ কেউ কথা বলতে বলতেই হঠাৎ উপলব্ধি করেন হয়ত বেশি বলছেন৷ বাকস্বাধীনতা চর্চার চেয়ে তখন পরিবারের সুরক্ষা তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে৷
আঠারো কোটি মানুষের দেশে ভয়ের সংস্কৃতি বেশ ভালোই ছড়িয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে৷ এই ভয় তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখছে, বোবা করে রাখছে৷ ক্ষমতাসীনদের জন্য এটা এক বড় সাফল্যই বটে!