বড়দিনে জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতির ‘অজনপ্রিয়' কথা
২৫ ডিসেম্বর ২০১৯বিশেষ বিশেষ ধর্মীয় দিবসগুলোতে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ধর্মের উদারতার বাণীগুলো প্রচার করা হয়৷ এমন দিনগুলোতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও একটু গুরুত্ব পান৷ অনেক দেশে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন তারা৷ সেখানেও শোনা যায় ধর্মের মানবতাবাদী অনেক বাণী৷ যেসব দেশে দ্বিতীয় কোনো ধর্মের সাংবিধানিক অস্তিত্ব বা স্বীকৃতি নেই সেসব দেশে অবশ্য এমন অনুষ্ঠান হয় না৷ সেসব দেশ নিয়ে আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়৷ এমনকি যেসব দেশে সব ধর্মের অস্তিত্ব নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে স্বীকৃত, যেসব দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালন নিশ্চিত করতে বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন পড়ে না, সেসব দেশকেও এ আলোচনায় না রাখলে চলে৷
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সংখ্যালঘুর জন্য নিরাপদ ভূমি বিশ্বমানচিত্রে ক্রমশ কমছে৷
মূল প্রসঙ্গ, অর্থাৎ, বড়দিন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দেয়া বক্তব্যে ফিরি৷বঙ্গভবনে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে এবং যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করতে না পারে সে বিষয়ে সজাগ থাকতে বলেছেন তিনি৷আরো বলেছেন, ধর্ম মানুষকে আলোর পথ দেখায় এবং অন্যায়, অবিচার ও অন্ধকারের পথ পরিহার করার শিক্ষা দেয়৷ প্রতিটি ধর্মের মূল বাণী ও শিক্ষা হচ্ছে মানবকল্যাণ৷ ‘‘তাই ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে কেউ যাতে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে এবং মানুষকে, বিশেষত যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করে ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, সে ব্যাপারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে সজাগ থাকতে হবে৷''
রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের বলা প্রতিটি কথা খুব ঠিক এবং খুব প্রাসঙ্গিক৷ প্রকারান্তরে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে সমাজের বড় একটা অংশকে বিভ্রান্ত করার চলমান বাস্তবতাকে স্বীকার করায় রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ৷ আমরা জানি, এ প্রবণতা নতুন নয়৷ আমরা জানি, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা বহুদিন ধরেই কমছে৷ আমরা জানি, এ প্রবণতা পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমারের মতো দেশের সঙ্গে মেলে৷ আরো জানি, মোদী সরকারও ভারতকে সেরকম দেশ বানানোর পথে হাঁটছেন৷ ভারতের বিরোধীদলগুলো এর বিরুদ্ধে সোচ্চার৷ কিন্তু পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা মিয়ানমারের মতো দেশগুলোতে কি কখনো সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সরকার বা বিরোধী দলগুলোকে কখনো সেভাবে সক্রিয় হতে দেখা গেছে? তা দেখা না গেলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ধর্মের উদারতার বাণী কিন্তু ঠিকই প্রচারিত হয়েছে৷ আজও নিশ্চয়ই হচ্ছে, যদিও শুধু বাণী খুব বেশি গুরুত্ব পায় না, শুধু বাণী দিয়ে সমাজে ন্যায়প্রতিষ্ঠাও হয় না৷
তাই রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের কাছেই জানতে চাই, ধর্মের অপব্যাখ্যা কারা করে? অপব্যাখ্যা করে তারা যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, তা দেখার, তা প্রতিরোধ করার জন্য কি আর কেউ নেই? থাকার দরকার নেই? জনগণকেই তা দেখতে হবে?এটা হয় কখনো?
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, কথার সঙ্গে কাজের মিল না থাকলে খুব ভালো ভালো কথাও গুরুত্ব হারায়৷ আপনি না জানলে জানিয়ে রাখি, ঈদ, বড়দিন, দুর্গাপূজা, বৌদ্ধপূর্ণিমা বা অন্য কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে যখন যিনি যত ভালো কথাই শুনিয়েছেন, কোনো কথার গুরুত্ব কেউই দেয়নি, এখনো দেয় না৷ তাই আপনার স্ত্রী-র সঙ্গে রসিকতার বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হলেও ধর্মীয় দিবসের ধর্মের বাণী তেমন কেউ শোনে না৷
বড়দিনে পোপ ফ্রান্সিসও নিয়ম মেনে বাণী দিয়েছেন৷ বলেছেন, ঈশ্বর সবাইকে ভালোবাসেন, এমনকি যারা ‘নিকৃষ্ট' তাদেরও ভালোবাসেন৷ এমন বাণী শোনালেও, কিছু ‘নিকৃষ্টের' কারণে বিশ্বের নানা গির্জায় যে যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের অপকর্ম হয়েছে, সে বিষয়ে সরাসরি কিছু বলেননি৷ তার বাণীও ভ্যাটিকানে উপস্থিত শ্রোতাদের বাইরে কতজন মন দিয়ে শুনবেন, আমার জানা নেই৷
বড়দিন উপলক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের ডেভিড ওয়েন অলিভারও খুব চেঁচিয়ে, ‘‘মেরি ক্রিস্টমাস'' বলেছেন৷ বলার সময় রাস্তায় ছুড়ে ছুড়ে টাকাও ফেলেছেন৷ সেই টাকা কোথায় পেয়েছেন তা কিন্তু বলেননি৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, টাকাগুলো ব্যাংকডাকাতি করে পেয়েছিলেন ডেভিড ওয়েন অলিভার৷ ধরা পড়ার পরে নিশ্চয়ই বুঝেছেন, অবৈধ উপায়ে পাওয়া টাকা আর নিজের কাজে লাগবে না, তাই টাকা ছড়িয়ে ‘মেরি ক্রিস্টমাস' বলার সুযোগটা তিনি ছাড়েননি৷
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর মানুষরা নিশ্চয়ই আজ পুলিশকে, প্রশাসনকে মন থেকে বড় দিনের শুভেচ্ছা জানাবেন৷
আসলে সমাজকে সুন্দর রাখার, সমাজে ন্যায়প্রতিষ্ঠার সদিচ্ছা না থাকলে বাণী কোনো গুরুত্ব বহণ করে না৷
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘সাম্যবাদী' কবিতায় যথার্থই লিখেছিলেন, ‘‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই৷''