সুখাদ্য ফেরাবে ভারতীয় রেল
১০ মার্চ ২০১৪কিছু কিছু খাবার আছে, যেগুলো সুখাদ্যের উপকথায় অমরত্ব পেয়েছে৷ হয়ত এমন কিছু আহামরি বা মহার্ঘ খাবার নয়, কিন্তু খাদ্যরসিকদের রসনায় তাদের স্বাদ এমন পাকাপাকি জায়গা পেয়ে গেছে যে সময়ের এবং পছন্দের খামখেয়ালিপনাও সেই সব খাবারের কৌলিন্যে এতটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি৷ যেমন ধরা যাক গোয়ালন্দের স্টিমারের মাঝি-মাল্লাদের রান্না করা ঝাল ঝাল মুরগির ঝোল, যাকে সাহেবরা নাম দিয়েছিলেন ‘‘গোয়ালন্দ স্টিমার কারি''৷ বহু প্রবীণ মানুষ আছেন, যাঁরা এখনও এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম সাদা ভাত আর ওই মুরগির ঝোলের জন্য আরও একবার অতীতে ফিরে যেতে রাজি৷ এতই জনপ্রিয় হয়েছিল এই ‘‘গোয়ালন্দ স্টিমার কারি'', যে ব্রিটিশ ভারতের রেলপথের অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে গিয়েছিল এর চাহিদা৷
অথবা ধরা যাক ‘‘রেলওয়ে মাটন কারি''৷ পাঁঠার মাংসের এই ঝোলটিও একটা সময় বিত্তবানের রেলযাত্রার আবশ্যিক পাথেয় হয়ে উঠেছিল৷ ঠিক যেমন বিখ্যাত হয়েছিল ‘‘ম্যাড্রাস ক্লাব কোর্মা'' বা ‘‘রেলওয়ে চিকেন কাটলেট''৷ দেশীয় সুখাদ্যের পাশাপাশি সাহেবসুবোদের পছন্দসই ওইসব খাবারও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল রেলযাত্রীদের মধ্যে৷ যেমন ওই কাটলেট, বা বিখ্যাত ‘‘মুলিগাটানি স্যুপ'' অথবা হরেক ধরনের কাস্টার্ড এবং পুডিং৷
এটা সেই আমলের কথা, যখন প্রতিটি দূরপাল্লার ট্রেনে থাকত সুসজ্জিত ডাইনিং কার, নিখুঁত ইওরোপীয় কায়দাতেই৷ মাথায় পাগড়ি এবং দুধসাদা পোশাকের ওপর কোমরবন্ধ আঁটা খানসামারা এসে টেবলে টেবলে খাবার সার্ভ করতেন৷ আর রেল কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্তা এবং পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য থাকত আরও এলাহি আয়োজন৷ তাঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব সেলুন-কার থাকত, যে কামরায় বাবু-বিবির শোওয়ার ঘরের লাগোয়া থাকত বসার ঘর, রান্নাঘর এবং ব্যক্তিগত পরিচারক ও ভৃত্যদের আলাদা ঘর৷ রেলযাত্রা তখন ছিল এক চূড়ান্ত বিলাসিতা, যার শেষ কথা হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে, সংক্ষেপে বিএনআর, যা আজকের ভারতীয় রেলওয়ের দক্ষিণ-পূর্ব শাখা৷
বলা বাহুল্য যে সেই রাজ জমানা যেমন আর নেই, ভারতীয় রেলের সেই সুদিনও বহু বছর আগেই বিদায় নিয়েছে৷ এখন রেলযাত্রার সময় সাবধানী পর্যটক উপায় থাকলে বাড়ি থেকে খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যান৷ কারণ, রেলের খাবার এখন মুখে দেওয়া যায় না, এতটাই বিস্বাদ৷ এবং কখনও কখনও এমনই অস্বাস্থ্যকর সেই খাবার যে মাঝপথে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে সেই খাবার খেলে৷ নানা কারণে দূরপাল্লার ট্রেনে আর আলাদা ডাইনিং কার বা প্যান্ট্রি কার থাকে না৷ সব মিলিয়ে রেল সফরের সেই দারুণ রোমান্টিকতা আজ বিলকুল উধাও৷ কিন্তু অন্যরকম ভাবতে চাইছে ভারতীয় রেলের অধীনস্থ সংস্থা আইআরসিটিসি, যারা এখন রেলের খাবার সরবরাহ ও পরিবেশনের দায়িত্বে আছে৷ রেলদপ্তরের নিজস্ব রেস্তোরাঁ খোলার পরিকল্পনা করেছে ওরা, যেখানে পাওয়া যাবে পুরনো আমলের সেই সব অবিস্মরণীয় সুখাদ্য৷
সন্দেহ থাকতে পারে যে এখনও কি ওইসব খাবারের চাহিদা থাকবে, বিশেষত আধুনিক প্রজন্মের কাছে? যাঁরা রেস্তোরাঁ ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন, তাঁরা কিন্তু জোর দিয়ে বলছেন যে হ্যাঁ, আছে৷ কারণ গড়পড়তা ভাত-মাছ বা রুটি-মাংসের হোটেলের বাইরে গিয়ে একাধিক ‘‘ফাইন ডাইনিং''-এর রেস্তোরাঁ খুলেছে বিভিন্ন শহরে এবং জনপ্রিয় হয়েছে৷ ভারতীয় বা বাঙালি খাবার পাওয়া যায়, এমন অনেক রেস্তোরাঁতেই এখন পুরনো আমলের খাবারই সবথেকে বেশি অর্ডার দেওয়া হয়৷ লোকে সেসব পছন্দ করছেন এবং বেশ ভালোবেসেই খাচ্ছেন৷ তাছাড়া সামগ্রিকভাবেও ভারতীয় খাবারের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা এখন রীতিমত উজ্জ্বল৷ চলতি হিসেবে প্রায় ৭৬,০০০ কোটি টাকা লগ্নি আছে এই সুখাদ্য ব্যবসায় এবং প্রতি বছর ১১ শতাংশ হারে তার বৃদ্ধি ঘটছে৷ সুতরাং আইআরসিটিসি অত্যন্ত আশাবাদী যে ভারতীয় রেলওয়ের ইতিহাসের পাতা থেকে ফিরিয়ে আনা সুখাদ্য সম্ভার রসিকদের মন জয় করবে৷
আর শুধু সুখাদ্যই নয়, রেল বিভাগের ওই রেস্তোরাঁয় থাকবে রেল সফর বিষয়ক নানা স্মারক, পুরনো স্টিম লোকোমোটিভ, ভিতরে তেলের বাতি জ্বালানো, লাল-সবুজ কাঁচ বসানো পিতলের লন্ঠন, যা আরও বেশি করে ফিরিয়ে আনবে পুরনো দিনের আবহ, স্মৃতির রেলপথ ধরে ফিরিয়ে আনবে কু ঝিক ঝিক নস্ট্যালজিয়া৷