1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ব্রিকসে সদস্যপদ না পাওয়ার কারণে অপশন খোলা থাকল

১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান

https://p.dw.com/p/4VpKG
Bangladesch | Mohammad Tanzimuddin Khan
ছবি: Privat

সম্প্রতি সাউথ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকসের সম্মেলনে সদস্যপদ পায়নি বাংলাদেশ। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের জোটে বাংলাদেশের যাওয়া না যাওয়ায় বিষয়টি নিয়েও চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ব্রিকসে সদস্যপদ না পাওয়ায় বাংলাদেশের জন্য ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে? বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোটে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান।

ডয়চে ভেলে : ব্রিকসে সদস্যপদ কেন পেল না বাংলাদেশ?

অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান : এখানে ২২টি রাষ্ট্র আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রকে সদস্যপদ দেওয়া হল। তাতে দেখা যাচ্ছে কৌশলগতভাবে যারা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যারা এনার্জি রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তারা সদস্যপদ পেয়েছে। যেমন সৌদি

আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত মূলত তাদেরই বিবেচনা করা হল। ব্রিকসে রাশিয়া, চীন এবং ভারত খুবই শক্তিশালী। সেক্ষেত্রে এই তিন দেশের সম্মতিটা গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যম থেকে আমরা যতদূর জেনেছি, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের একটা ভিন্ন অবস্থান ছিল। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন, রাশিয়া ও ভারত একটা নির্দিষ্ট বলয়েই তাদের অবস্থান। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে ভারতের অবস্থান। ফলে ভারতের হিসাবটা চীন ও রাশিয়ার মতো হবে না। সেটা একটা বড় কারণ হতে পারে বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়ার। আরেকটা বিষয় হল, সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের যে ধরনের আনুষ্ঠানিক তৎপরতা থাকার কথা ছিল সেটা খুব স্পষ্ট ছিল না। এই ধরনের জোটে সদস্য হতে গেলে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে আবেদন করতে হয়। তখন অনেক বিষয় বিবেচনা করে সদস্যপদের বিষয়টি নির্ধারণ হয়।

প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার পর অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশ ব্রিকসে সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো হল না। এতে কী অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী খানিকটা চাপে পড়তে পারেন?

এই সদস্যপদ পাওয়া না পাওয়ার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে গত দু'টি নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে তাতে নির্বাচনী ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের খুব বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে বিদেশি শক্তির সমর্থন। যেহেতু বাংলাদেশের রাজনীতিকে ঘিরে একটা মেরুকরণ দেখছি, যে মেরুর এক প্রান্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যপ্রান্তে রাশিয়া-চীন। যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে নেই, সেটা বিএনপির পক্ষে থাকুক আর না থাকুক মূল কথা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানটা ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চীন-রাশিয়া নির্বাচন নিয়ে যে ধরনের বিবৃতি দিয়ে আসছে তাতে এটা স্পষ্ট যে আমরা নির্বাচন নিয়ে বিদেশি শক্তির উপর নির্ভর করছি। কিন্তু ব্রিকস সদস্যপদ পাওয়া না পাওয়া নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলবে এমন না। এর মধ্যে দিয়ে হয়ত রাজনৈতিক হাইপ তৈরি করা যায় কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতির সঙ্গে মেলালে হবে না। ব্রিকসের কাঠামোই এখন তৈরি হয়নি। এখানে যারা সদস্য হয়েছে তাদের বৈশিষ্ট্য যদি দেখেন, এখানে যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে, তেমনি স্বৈরাচারী রাষ্ট্রও আছে। আবার ধনী রাষ্ট্র যেমন আছে, তেমনি ইথিওপিয়ার মতো রাষ্ট্রও আছে।

সদস্যপদ না পাওয়া কী কূটনৈতিক ব্যর্থতা?

বরং সদস্যপদ না পাওয়াটা আমাদের জন্য ভালো হয়েছে। সদস্যপদ পেলে আমরা যে চীন, রাশিয়া ও ভারতের বলয়ে অবস্থান করছি, সেটার স্পষ্টতা তৈরি হত। বরং এটা আমাদের জন্য অপশন তৈরি হল। নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি রাষ্ট্রের মধ্যে যে মেরুকরণ দেখছি, তার বাইরে থেকে কিছু করার সুযোগ আছে। এখানে সদস্য হলে খুবই স্পষ্ট হতো আপনি একটা বলয়ে অবস্থান করছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর আমরা দেখছি, রাশিয়া, চীন, ভারত একটা বলয়ে আছে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা আরেকটা বলয়ে আছে। ব্রিকসে সদস্যপদ না পাওয়াটা হতাশার না। বরং এটার ফলে বাংলাদেশের জন্য একটা অপশন খোলা থাকল।

ব্রিকসের সদস্যপদ পেলে কী সুবিধা পাওয়া যেতো?

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তন হচ্ছে তাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ করে চীন বিশ্ব নেতৃত্বে প্রথম সারিতে অর্থাৎ শীর্ষেই থাকবে। আমাদের যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন সেখানে তো আমরা অনেক বেশি মাত্রায় চীনের উপর নির্ভরশীল। এখন আমরা ব্রিকসের সদস্য হলে সেই সম্পর্কটা আরও বেশি শক্তিশালী হতো। আবার রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটাও। সবকিছু মিলিয়ে আস্থার জায়গাটা একটা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেত।

বিবেচনা করতে হবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে ভিন্ন অবস্থান সেক্ষেত্রে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভূমিকাকেও দূরে ঠেলে দিতে পারেন না। এই পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি স্পর্শকাতর করে তুলেছে।

ব্রিকস কি পশ্চিমা বিশ্বের বিরোধী একটা জোট? তাহলে সদস্য হলে কী বাংলাদেশকে আরও বেশি পশ্চিমা বিশ্বের চাপের মুখে পড়তে হত?

ব্রিকসের এখনও সুস্পষ্ট কোন বৈশিষ্ট তৈরি হয়নি। আপাতত মনে হচ্ছে, চীন, রাশিয়া ও ভারত এটা তৈরি করেছে। তারাই তো এটা প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ধরনের একটা ভাবমুর্তি আছে, কেউ কেউ এমন প্রত্যাশাও করে ব্রিকস একটা পশ্চিমা বিরোধী জোট হবে। কিন্তু এখনও ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর মতাদর্শিক অবস্থান দেখেন বা অর্থনৈতিক অবস্থান দেখেন। এখানে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র যেমন আছে, দুর্বল রাষ্ট্রও আছে। ফলে এটাকে এখনই পশ্চিমা বিরোধী বলা যাবে কিনা সেটা এখনই বলা সহজ হবে না।

সার্কে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা শক্তিশালী?

সার্কের জন্মের পেছনে তো বাংলাদেশই মূল নেতৃত্ব দিয়েছে। সেদিক থেকে তো বাংলাদেশ শক্তিশালী। সার্কের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সেখানে অন্য রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারতের ভূমিকা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু ভারত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় খুবই প্রভাবশালী ফলে তাদের উপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে তাদের নেতৃত্বটা নিশ্চিত করতে পারল কিনা। এখানে পকিস্তানের ভূমিকাকেও পেছনে ঠেলে দেওয়া যাবে না। ভারত পাকিস্তানের বিরোধ ঘিরেই কিন্তু সার্কের অচলাবস্থা। ফলে বাংলাদেশ কতটুকু প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করতে পারবে সেটা এই দুই রাষ্ট্রের উপরই নির্ভর করে।

'ব্রিকসে সদস্যপদ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের সম্পর্ক নেই'

বিমসটেক থেকে বাংলাদেশ কী সুবিধা পাচ্ছে?

বিমসটেক থেকে ফলপ্রসূ কিছু দৃশ্যমান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে চীন-ভারতের সম্পর্ক ঘিরে যে ধরনের টানাপোড়েন আছে তাতে বিমসটেক যে সফল হচ্ছে সেটা এই মুহূর্তে বলা যায় না। সেই অর্থে বাংলাদেশও যে লাভবান হচ্ছে তা না। কিন্তু এই ধরনের জোটে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করা ও সুসংহত করা দেশের স্বার্থে কাজে আসে।

বিভিন্ন আঞ্চলিক জোটে বাংলাদেশের সংযুক্তি কতোটা উদ্বেগের বা সাফল্যের?

বাংলাদেশ কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। বিশ্ব রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতির বাস্তবতায় বাংলাদেশ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশ যে মডেলকে সামনে নিয়ে এসেছে তাতে বাংলাদেশকে নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অনেকের আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিদেশিদের এখানে বিনিয়োগের জায়গা তৈরি হচ্ছে। সেই অর্থে বাংলাদেশ তাদের আগ্রহের কেন্দ্রে আছে। সেটা আইএমএফ হোক বা ওয়ার্ল্ড ব্যাংক হোক বা ভারত-চীনের কারণেই হোক। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমাদের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অনুপস্থিতির কারণে আমরা কিন্তু বিদেশি শক্তিকেই খুবই সহজ শর্তেই উন্নয়নকে সামনে নিয়ে আসছি। ফলে জোটবদ্ধ হওয়া কোন সমস্যা না বরং নতুন নতুন সুযোগ তৈরি হয়।

আগামী মাসে ভারতে জি-২০ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ পেয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য এর গুরুত্ব কী?

এই ধরনের আমন্ত্রণ সব সময় সম্মানের। যেহেতু সামনে বাংলাদেশে নির্বাচন, ফলে রাজনীতিকে ঘিরে আমরা নানা ধরনের মেরুকরণ দেখছি প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। সেক্ষেত্রে এই ধরনের আমন্ত্রণ অনেক সময় জনপরিসরে অনেক ধরনের সন্দেহ তৈরি করে। এসবের বাইরে এই ধরনের সম্মেলনে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশকে সম্মানিত করবে। এটা নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা না। তবে নির্বাচনকে ঘিরে মেরুকরণ আছে বলে অনেক সময় মানুষের ভিন্ন চিন্তাও তৈরি হয়।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷