প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে সৌর বাতি
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯প্রান্তিক কালুঙ্গা সম্প্রদায়ের দুর্দশা
প্রায় ৩ শতাব্দী ধরে ব্রাজিলের বুকে কালুঙ্গারা বসবাস করছেন৷ তাঁদের পূর্বপুরুষরা আশেপাশের স্বর্ণখনিতে ক্রীতদাস হিসেবে কাজ করতেন৷ তারপর পালিয়ে গিয়ে জঙ্গলে বসবাস শুরু করেন৷ ক্রীতদাসদের উত্তরসূরি হিসেবে কালুঙ্গারাই সবচেয়ে বড় গোষ্ঠী৷ বেশ কয়েকটি ছোট জনপদে তাঁরা বসবাস করেন৷
আবার ক্রীতদাস হবার ভয়ে কালুঙ্গাদের অনেক জনপদ গত শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্তও বহির্জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল৷ কালুঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে আদির সোয়ারেস সুসা বলেন, ‘‘আমরা কার্যত লোকচক্ষুর অন্তরালেই বসবাস করছি৷ আমাদের সাহায্য করার কেউ নেই৷ রাস্তাঘাট, সুস্থ জীবনের জন্য বিশুদ্ধ পানি, স্কুল-কলেজ, বিদ্যুৎ – কিছুই আমাদের নেই৷’’
এখনো পর্যন্ত অবস্থা খুবই কঠিন ছিল৷ তাঁর গ্রাম রাজধানী ব্রাসিলিয়া থেকে মাত্র ২৫০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও সেটি বহির্জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন৷ শাপাদা দোস ভেইয়াদেইরস জাতীয় অরণ্যের মাঝে গ্রামটি অবস্থিত৷ পার্কটি ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় রয়েছে৷ আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলের মতো ব্রাজিলের মধ্যভাগে সেরাডো-র অংশ এটি৷
তিনি যে আধুনিক সভ্যতা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন, প্রতি সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর আদির সুসা তা টের পান৷ সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই তাঁর বাড়িতে ঘন অন্ধকার নেমে আসে৷ তাঁর স্ত্রী আগেই নৈশভোজ প্রস্তুত করেন৷ কিন্তু বাসনপত্র দেখার জন্য তাঁর কাছে শুধু একটা ছোট ডিজেলচালিত বাতি রয়েছে৷ কিন্তু সেই বাতির দুর্গন্ধ ও তাতে আগুন লাগার ভয় কম নয়৷ আদির বলেন, ‘‘বিদ্যুত ছাড়া জীবন মানেই কষ্টের জীবন৷ অনেক কাজ হয় না, সবকিছু থেমে থাকে৷ সন্ধ্যা নামলেই কাজ করার জো নেই৷ পরের দিন আলো আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়৷’’
সৌরশক্তিচালিত বাতির প্রয়োগ
লিট্রো দে লুস নামের এনজিও কালুঙ্গা সম্প্রদায়ের জীবনে আলো আনতে চায়৷ সেই লক্ষ্যে তারা নতুন গির্জাটিকে সাক্ষাতের স্থান ও প্রযুক্তিকেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে৷ অনেকেই সেখানে গিয়ে সৌরশক্তিচালিত বাতি তৈরির পদ্ধতি শিখতে চান৷ রিসাইকেল করা প্লাস্টিক বোতল দিয়ে সেগুলি তৈরি করা হয়৷
গ্রামে অনেক মানুষেরই অক্ষরজ্ঞান নেই৷ তাই বাতি তৈরির পদ্ধতির কোনো লিখিত রূপ নেই৷ তা সত্ত্বেও সমস্যার মুখে পড়লে সাহায্য করা হয়৷ এই দিকে ব্যাটারি লাগাতে হবে৷ কালোর সঙ্গে কালো, লালের সঙ্গে লাল মিলিয়ে৷ ভুল করলে পুড়ে যেতে পারে৷ এই বাতি ৫ ঘণ্টা ধরে জ্বলে৷ তারপর এক সৌর প্যানেলে সেটি আবার চার্জ করা যায়৷ তবে এমন বাতির আয়ু সাধারণত ২ বছরের বেশি হয় না৷
এই সংগঠন প্রস্তুতকারকের কাছ থেকেই সস্তায় উপাদান সংগ্রহ করে৷ ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় ‘সামাজিক প্রযুক্তি' বিভাগে পাওয়া প্রায় ২৫,০০০ ইউরো মূল্যের পুরস্কারের অর্থ দিয়েই এই এনজিও কাজ চালায়৷
৩ মাসেরও বেশি সময় ধরে লিট্রো দে লুস কালুঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করেছে৷ সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী কামিলা রেবেলো আমুই বলেন, ‘‘সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি৷ বিভিন্ন ধরনের চাহিদা বুঝতে আমরা প্রত্যেকটি মানুষ ও তার নিজস্ব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত হয়েছি৷’’
দেশজুড়ে সৌর বাতি চালু
‘লিটার অফ লাইট’ নামের এক আন্তর্জাতিক সংগঠন ২০১৪ সালে ব্রাজিলে ‘লিট্রো দে লুস’ নামের শাখা খোলে৷ তখন থেকে এই সংগঠন ব্রাজিলে ১০,০০০-এরও বেশি মানুষের কাছে আলো পৌঁছে দিয়েছে৷ সে দেশে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন৷ সাঁও ডোমিঙ্গোস শহরে স্থানীয় তরুণরা সৌরশক্তিচালিত ল্যাম্প পোস্ট তৈরি করেছেন৷ গ্রামের মানুষ আগে থেকেই তার জন্য জায়গা চিহ্নিত করেছিল৷ যেমন নতুন এক উৎসব প্রাঙ্গণের সামনে, অথবা স্কুলের সামনে৷ ফলে অনেকেই খুশি৷ কেউ কেউ আগে সন্ধ্যায় বাইরে যেতেন না, কারণ জঙ্গল ও সাপে ভরা জায়গাটা বিপজ্জনক ছিল৷ সাপের গায়ে পা পড়লে মৃত্যুর ভয় ছিল৷
নতুন আলোকসজ্জা সত্ত্বেও রাতে কার্যকলাপ শুরু হতে আরও সময় লাগবে৷ আদির সুসা-র পরিবারের জন্য সন্ধ্যায় নতুন এক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে৷ আদির বলেন, ‘‘আলো আসায় অবশ্যই অনেক উন্নতি হয়েছে৷ কারণ আগে বিকেল ৪টা বা ৫টার মধ্যে যে কাজ সেরে ফেলতে হতো, এখন তা সন্ধ্যা ৭টা, ৮টা পর্যন্ত তা করা যায়৷ দেরিতে রান্না করা যায়, নৈশভোজ সারা যায়, ঘুমাতে যাওয়া যায়৷’’
এই গ্রাম অদূর ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হবে বলে তাঁর আশা৷ প্রায় ২০০ বছর ধরে মানুষ ক্রীতদাসের জীবন থেকে পালিয়ে অন্ধকারে দিন কাটিয়েছে৷ এবার অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে৷
বিয়াংকা কপ্শ/এসবি