‘সংস্কার চাপিয়ে দিলে হবে না, সবাইকে নিয়ে করতে হবে’
২৩ আগস্ট ২০২৪ডয়চে ভেলে: এই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এই সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?
জাহেদ উর রহমান: এই সময়ে প্রাইম চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশের প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের যে কাজ করার কথা তার আশপাশেও তারা নাই৷ সরকারের দিক থেকেও বলা হচ্ছিল এটা ফার্ষ্ট চ্যালেঞ্জ৷ কিন্তু অ্যাচিভমেন্টের দিক দিয়ে ভালো কিছু হয়নি৷
এর কারণ কী? কোনো সংকট আছে?
সংকট তো আছেই৷ ৫ আগস্টের পর প্রচুর মানুষ থানা ঘেরাও করতে গেছে খালি হাতে৷ প্রচুর মানুষ তখন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন৷ মানুষ থানা ঘেরাও করতে গেছে, তারা মারা যাবে এটা না বোঝার কোনো কারণ নাই৷ তারপরও তারা গেছে৷ এর মানে হলো পুলিশের প্রতি মানুষের তীব্র ক্ষোভ আছে৷ এরশাদের পতনের পরও কিন্তু পুলিশকে এভাবে পালিয়ে যেতে হয়নি৷ তার মানে হলো, মারাত্মক রকম একটি পলিটিসাইজড পুলিশ, যেটা দিয়ে দলীয় ক্যাডারের মতো মানুষের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ণ করা হয়েছিল৷ পুলিশ বাহিনীর ক্রেডিবিলিটি এখন খুবই নিচু পর্যায়ে আছে৷ আর যা ঘটেছে, তাতে পুলিশও দায়িত্বে ফিরে আসতে ঝুঁকি বোধ করছে৷ অনেকে আসেনি, যারা এসেছে তারা মাঠেও যেতে চায় না৷ তারা থানাতেই থাকতে চায়৷ এই রকম সংকট তো আসলে আছে৷ ফলে পুলিশকে ঠিকভাবে কাজ করতে সময় লাগবে৷ আর এর দায় আসলে যে সরকারটা গেল তাদের ওপর বর্তায়৷ তারপরও পুলিশ যদি শেষ পর্যন্ত ঠিকঠাক মতো কাজ না করে এবং ওটা যদি দেরি হয়ে যায়, তাহলে মানুষ আসলে ওটা দেখতে যাবে না যে আগে কী হয়েছিল৷ মানুষ আসলে দেখতে চাইবে নতুন সরকার এসে কী করলো৷
তাহলে এই সরকারের জন্য সেকেন্ড চ্যালেঞ্জ কোনটি?
আমাদের অর্থনেতিক ক্রাইসিসটা কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মাথাচাড়া দিতে শুরু করবে৷ আমাদের ইনফ্লেশন ছিল৷ এর মধ্যে কিন্তু আমরা ইনফ্লেশনের ঝাঁজটা হয়তো একটু কম টের পেয়েছি৷ কারণ চাঁদাবাজরা পালিয়েছিল৷ বাজারে কিছুটা স্বস্তি দেখা দিয়েছিল৷ তবে সেটা সাসটেইন করবে কিনা...৷ রিজার্ভের ক্রাইসিস ছিল সেটা তো আছেই, সামনে এটা আরো চলবে৷ তাই সামনে ইকোনমিক চ্যালেঞ্জটা তারা কীভাবে ম্যানেজ করে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মিড এবং লং টার্মে৷ ওনারা তো আর লং টার্ম থাকবে না , মিড টার্মে এটা তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷
এই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য মানুষ তাদের কত সময় দেবে বা আপনি কত সময় দিতে চান?
শুধু যে রিজার্ভের অবস্থা খারাপ তা নয়, ব্যাংকিং সিস্টেমটা অলমোস্ট কলাপসড৷ এখন আমরা বুঝতে পারছি এস আলম গ্রুপ, সালমান এফ রহমানরা ব্যাংকিং ব্যবস্থাটা কোথায় নিয়ে গেছে৷ ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার ক্রাইসিস আছে৷ বহু কিছু৷ এটা সরকারের পতনের আগেই শুরু হয়েছে৷ বড় অংকের নগদ টাকা তোলা যেতো না৷ অনেক বড় না , কয়েক লাখ টাকা তুলতে গেলেই দেরি হতো৷ সময় লাগতো৷ এসব ঠিক করতে সময় লাগবে৷ আমি সময় দিতে চাই, কিন্তু আমি মনে করি মানুষ খুব বেশি সময় দেবে না৷ কারণ, এই ধরনের ক্রাইসিস মানুষকে অ্যাফেক্ট করে৷ তবে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ-এই জুটিটা ভালোভাবে কাজ করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ আর বিভিন্ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজি পণ্য মূল্য বাড়িয়ে দিতো, সেটা যদি এখন আর না হয়, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে৷ আমার মনে হয় সাধারণ মানুষ আগের চেয়ে ভালো কিছু দেখতে তিন মাসের বেশি অপেক্ষা করবে না৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছে? আর দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা যাবে?
বিগত সরাকারের সময়ে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল৷ করাপশন এবং মানি লন্ডারিং বিল্টইন, কারণ, কেউ যখন অবৈধ উপার্জন করবে, সেই টাকাটা সে তখন দেশে রাখা নিরাপদ মনে করবে না৷ এখন এর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক নেতারা আছেন, ব্যবসায়ীরা আছেন, আমলারা আছেন৷ তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে হবে৷ তারা যে অনুপার্জিত আয় করেছেন, তা রাষ্ট্রের অনুকুলে জব্দ করতে হবে৷ তাদের এই চেষ্টা করতে হবে৷ সফল কতটুকু হবে, সেটা পরের কথা৷ তবে তাদের চেষ্টা দৃশ্যমান হতে হবে৷
আমরা অনেক দুর্নীতিবাজকে চিনি৷ তার বাইরেও তো প্রশাসনে, পুলিশে বা অন্য সেক্টরে অনেক দুর্নীতিবাজ আছেন৷ তাদের কি ছাকনি দিয়ে বের করা সম্ভব?
এটা সঠিক যে, প্রত্যেক সেক্টরে প্রচুর করাপ্টেড মানুষ আছে৷ তবে আমি সিরিয়াসলি মনে করি যে, কোনো একটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হয়, তাহলে দুর্নীতি থামানো সম্ভব৷ এখানে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে৷ আওয়ামী লীগ তার শেষ দশ বছরে দুর্নীতি এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যে, এর প্রভাব থাকবে৷ তবে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি চাওয়া হয় যে, এটা আমরা আর করতে দেবো না, তাহলে এটা কমবে৷
ব্যাংকিং খাতে যে ঋণখেলাপির নামে লুটপাট হয়েছে ,আমাদের তথাকথিত আইনগত প্রক্রিয়ায় তা কত দিনে উদ্ধার করা সম্ভব, নাকি ভিন্ন কোনো আইন করতে হবে?
যারা এভাবে ঋণখেলাপি হয়ে রাষ্ট্রের সম্পদ লুট করেছে, তাদের অনেক সম্পদ আছে৷ কারো হয়তো বা দায়-দেনা সমান৷ আমরা যদি এই সম্পদ আইনগত প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের অনুকুলে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে অর্থ ফেরত পাওয়া যাবে৷ তবে এখানে একটি সংকট হচ্ছে, এই অর্থের বড় একটি অংশ পাচার করা হয়েছে ৷ এস আলমের ৯০-৯৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ আছে৷ এখন সে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি দেশের বাইরে পাচার করেছে৷ কিন্তু এই পাচার করা অর্থ ফেরত আনা একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ আমাদের যা করতে হবে, তা হলো, তাদের দেশে যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ আছে তা থেকে নিতে হবে৷
গণঅভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্র সংস্কার৷ সেটা প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ থেকে শুরু করে সব কিছু৷ এর জন্য কি সরকারের একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করা উচিত?
একটা রোড ম্যাপ থাকা উচিত৷ সামনে যে আলোচনটা সবচেয়ে বেশি হবে, সেটা হলো- সংস্কার কী চাইছি, সেটা কতটুকু করা সম্ভব, সেটা কতটুকু হচ্ছে৷ সংস্কারে সময় লাগবে৷ কিন্তু আপনি বিচার বিভাগ স্বাধীন করলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন করলেন এরপর নির্বাচন দিলেন৷ কিন্তু নির্বাচনের পর ওটা বজায় থাকবে না, যদি রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেক হোল্ডারদের আস্থা অর্জন করতে না পারেন৷ সংস্কার চাপিয়ে দিলে হবে না, সবাইকে সাথে নিয়ে সংস্কার করতে হবে৷
সংস্কারের প্রস্তুতি বা সংস্কার প্রক্রিয়া দৃশ্যমান করতে আপনি কতদিন সময় দিতে চান?
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে তাদের তিন মাস সময় দেয়া যায়৷ এরপর কিন্তু তাদের সংস্কারের রোডম্যাপ প্রকাশ করতে হবে৷ তারা রোডম্যাপ প্রকাশ করতে সর্বোচ্চ তিন মাস সময় নিতে পারেন৷
এই সরকারের সামনে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কী?
নির্বাচন কখন হবে, কীভাবে হবে এবং এই সরকারের যা যা ম্যান্ডেট আছে, তার বাস্তবায়নই তার জন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ৷ কেউ কেউ এই সরকারকে এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে তুলনা করছেন, কিন্তু এক এগারোর সরকারের সঙ্গে তুলনা সঠিক নয়৷ আসলে দুইটি সরকার এক নয়৷ এক-এগারোর সরকার ছিল একটি মিলিটারি ব্যাকড সরকার ৷ ওটা ক্যুর মাধ্যমে হয়েছে৷ কিন্তু এই সরকার হয়েছে একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে৷ ফলে এই সরকারের একটি পপুলার ম্যান্ডেট আছে৷ এখন দেশে দীর্ঘদিন ধরে কোনো সত্যিকার অর্থে নির্বাচন হয়নি৷ এখন রাজনৈতিক দলগুলো একটি ফেয়ার নির্বাচন চায়৷ তারা ক্ষমতায় যেতে চায় ৷ তাদের সাথে মতবিরোধ বা সংঘাতময় পরিস্থিতি হতে পারে৷ আর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যদি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে মাঠে আসে, তাহলে এই সরকারের একটি রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষও সামনে আসবে৷
রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে বিএনপি এই সরকারকে কত সময় দেবে?
বিএনপি বলেছে যে তারা সময় বেঁধে দেবে না৷ কিন্তু বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদে কিন্তু পরপর দুই বার ছয় মাস সময়ের কথা বলেছেন৷ বিএনপি আসলে আমার মনে হয় একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এইগুলো রেডি করতে যে সময় লাগে সেই সময় দেবে৷ বিএনপির কোনো কোনো নেতাকে আমি টকশোতে বলতে শুনেছি যে, তারা মনে করেন, সংস্কারগুলো যেমন বিচার বিভাগ সংস্কার- এগুলো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার করবে৷ অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের কথা বলছে, তাতে আমি মনে করি, তাদের সেটা করতে তিন বা ততোধিক বছর সময় লাগবে৷ কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এই পরিমাণ বা এর কাছাকাছি সময় বিএনপি দিতে চাইবে না৷