বেনজীরে নজির গড়বে দুদক?
২৪ মে ২০২৪বেনজীর আহমেদের মতো প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে আদালতের এ আদেশকে দুর্নীতিবিরোধী একটা বার্তা হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা৷
ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন বৃহস্পতিবার বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-কন্যার বিরুদ্ধে এই আদেশ দেন৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আদালতের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত ইতিবাচক৷ এই ঘটনায় জনগণের মধ্যে যে সংশয় ছিল, সেটা অনেকাংশেই দূর হবে৷ তবে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে না৷ আমাদের মামলার তদন্ত ও বিচার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷ অনেক সময় দেখা যায়, লোক দেখানোর জন্য অনেক কিছু করা হয়ে থাকে৷ এক্ষেত্রে দুদক আসলেই আন্তরিক কিনা সেটা দেখতে হবে৷ তবে আদালতের এই সিদ্ধান্তকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি৷”
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বেনজীর আহমেদের সম্পদ কেনার ৮৩টি দলিল জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ একই সঙ্গে তার স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা ৩৩টি ব্যাংক হিসাবও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত৷ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ এসেছে৷” পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে খুরশীদ আলম খান বলেন, "দুদক তদন্তকালীন সময়ে এই ধরনের আবেদন করে, কারণ, তদন্ত চলাকালে তিনি যেন সম্পদ হাতবদল করতে না পারেন৷ এখন তদন্তকারী দল তদন্ত শেষে কমিশনের কাছে রিপোর্ট দাখিল করবে৷ এরপর কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে৷ অভিযোগের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেলে কমিশন তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দিতে পারেন৷”
বেনজীরের সম্পদ অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার জহুরুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুর্নীতির বিষয়ে আমরা কোনো ছাড় দেই না৷ আইন অনুযায়ী যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, এখানেও আমরা সেটাই নেবো৷ আমাদের অনুসন্ধানকারী দল নিবিড়ভাবে বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে৷ অনুসন্ধান শেষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ শুধু এটুকু বলতে পারি, আমরা কোন ছাড় দেবো না৷”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "দুদকের প্রাথমিক যে উদ্যোগ সেটাকে আমি ইতিবাচকই বলবো৷ কারণ, অনেক প্রভাবশালীর দুর্নীতি অনুসন্ধানে গিয়ে কিন্তু দুদক সম্পত্তি জব্দের আবেদন করে না৷ এখানে বেনজীর আহমেদের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সম্পদ জব্দের আবেদন করেছে দুদক৷ দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতেই আদালত এই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন৷ তাই আমি মনে করি, বেনজীরের বিষয়ে এখন পর্যন্ত দুদকের আন্তরিকতাই আমরা দেখতে পাচ্ছি৷ তবে শেষ পর্যন্ত কী হয়, সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে৷”
বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধানে একটি কমিটি করার কথা গত ২২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন৷ এরপর ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক আদেশে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অগ্রগতির বিষয়টি হলফনামা আকারে দুই মাস পর জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন৷
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন৷ এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র৷ ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন, যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল৷
বেনজীর আহমেদের সম্পদ জব্দে আদালতের আদেশের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অপরাধ করে কেউ পার পাবেন না৷ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) স্বাধীন৷ বিচার বিভাগ স্বাধীন৷ বিচারে যদি কেউ অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হন, তারা তাকে কেন রক্ষা করতে যাবেন? ব্যক্তি যতই প্রভাবশালী হোন, অপরাধ করলে শাস্তি তাকে পেতে হবে৷ শুক্রবার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘বিষয়টি দেখতে হবে, ব্যক্তি যত প্রভাবশালী হোক, অপরাধ করতে পারে, অপকর্ম করতে পারে৷ কথা হচ্ছে, এ ব্যাপারে তাদের অপকর্ম-অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে সরকার সৎসাহস দেখিয়েছে কিনা৷ অপরাধীদের শাস্তি দিতে শেখ হাসিনা সরকারের সৎসাহস আছে৷ অপরাধ করে কেউ পার পাবে না৷ অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয় কেউ, আমরা তাকে প্রোটেকশন দিতে যাবো কেন? তিনি সাবেক আইজিপি হোন আর সাবেক সেনাপ্রধান হোন৷ আমাদের দেশের প্রচলিত আইন তাদের বিচারের কাছে সমর্পণ করবে৷''
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাতে সরকারের কোনো দায় নেই৷ তিনি অবসর নেওয়ার পর এই অভিযোগ উঠেছে৷ আর তার বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকারই৷ ফলে এখানে সরকারকে দায়ি করার সুযোগ নেই৷”
বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালের কণ্ঠ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট৷ এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তার পরিবার৷ এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাদের৷ ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের৷ এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷
প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন বেনজীর আহমেদ৷ ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, তার পরিবারের যে সম্পদ রয়েছে, তা বৈধ এবং এর হিসাব ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ রয়েছে৷ অবৈধ যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, তা যদি কেউ প্রমাণ করতে পারেন ওই ব্যক্তি বা গ্রুপকে তিনি সেই সম্পত্তি বিনা পয়সায় লিখে দেবেন বলেও ভিডিওতে দাবি করেন৷
এরপর বেনজীর আহমেদের সম্পদের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়৷ ওই রিটে কালের কন্ঠের প্রতিবেদনের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতি নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন রিগ্যান আবেদনকারী হিসেবে এই রিট করেন৷
আইনজীবী মো. সালাহ উদ্দিন রিগ্যান বলেন, "প্রকাশিত ওই সংবাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চেয়ে ৪ এপ্রিল দুদকের কাছে আবেদন করা হয়৷ এতে ফল না পেয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ১৮ এপ্রিল দুদক বরাবর আইনি নোটিশ পাঠানো হয়৷ এর কোনো জবাব না পেয়ে অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয়েছে৷ আমি বলছি না, বেনজীর আহমেদ অবৈধভাবে বা দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করেছেন বা করেননি৷ তবে প্রতিবেদনের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অনুসন্ধান হওয়া উচিত৷ কারণ, প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জনগণ মনে করেন, পুলিশের সাবেক আইজিপি অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করেছেন৷ দুদক অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিলে এই বিষয়ে প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হবে৷ এরপর হবিগঞ্জ-৪ আসনের এমপি ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনও আদালতে আবেদন করেন৷ এর মধ্যে দুদক থেকে জানানো হয়, তারা বেনজীর আহমেদের সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছেন৷