বেতন বাড়বে, মূল্যস্ফীতিও বাড়বে?
৯ জুন ২০২৩মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন কীভাবে বাড়ানো হচ্ছে তা এখনো স্পষ্ট নয়৷ বেতন বৃদ্ধি জুলাই থেকে কার্যকর হতে পারে৷ সরকারি চাকুরেরা শতকরা ২০ ভাগ মহার্ঘ্য ভাতা দাবি করেছিলেন৷
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরেদের সর্বশেষ পে-স্কেল ঘোষণা করা হয় ২০১৫ সালে৷ প্রতি পাঁচ বছর পরপর তাদের বেতন বাড়ার কথা৷ আট বছর হয়ে গেলেও করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই সময়ে আর বাড়ানো হয়নি৷ তবে প্রতিবছর শতকরা পাঁচ ভাগ হারে ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয়েছে৷ সেই হিসেবে সরকারি কর্মচারীরা আট বছরে ৪০ ভাগ ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন৷
কিন্তু অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি চাকুরেরা মোট কর্মরত জনগোষ্ঠীর পাঁচ ভাগের বেশি নয়, তাই তাদের বেতন বাড়ালে বাকিদের কী হবে? আসলে এখন প্রয়োজন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ৷ তা না করে বেতন বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে৷ মে মাসে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো যে মূল্যস্ফীতির হিসাব দিয়েছে তা গত এক দশকে সর্বোচ্চ ৯.৯৪ শতাংশ৷
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে সরকারি চাকরিজীবী প্রায় ১৪ লাখ৷ তবে বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এই সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ৷ চলতি অর্থবছরে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা খাতে ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা লাগছে৷ প্রস্তাবিত বজেটে (২০২৩-২৪) বেতন-ভাতা বাবদ ৭০ হাজার ৭০১ কোটি টাকা এবং পেনশন বাবদ ২৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে৷ সব মিলিয়ে বরাদ্দ ৯৩ হাজার ৭০১ কোটি টাকা৷
সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা, পেনশনসহ অন্যান্য খরচ বাবদ মোট বাজেটের ২২ থেকে ২৮ শতাংশ ব্যয় হয়৷ আর গত এক দশকে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের খরচ ২২১ ভাগ বেড়েছে৷ সর্বশেষ জনশুমারি বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ৷ সেই হিসেবে সরকারি চাকরিজীবীরা দেশের মোট জনগোষ্ঠীর দেড় শতাংশেরও কম৷
গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই অনুযায়ী অর্থ মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করেছে বলে আমরা জেনেছি৷ আমাদের প্রতিবছর যে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেয়, এবার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে আরো কিছু বাড়িয়ে দেয়া হবে৷ তবে সেটা আসলে না দেয়ার আগে আমরা বুঝতে পারছি না যে, আমাদের কী পরিমাণ দেয়া হবে৷ তবে মহার্ঘ্য ভাতা না দেয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাদের বেতন বাড়ানোর জন্য এখন আর নতুন পে কমিশন হচ্ছে না৷’’
‘বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘‘গত আট বছরে গড়ে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি ছিল আট শতাংশের উপরে৷ আর ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় পাঁচ শতাংশ করে৷ মূল্যস্ফীতির হিসেবে আমাদের পাওনা হয়েছে ৬৪ শতাংশ৷ কিন্তু আমরা ইনক্রিমেন্ট পেয়েছি মোট ৪০ শতাংশ ৷ তাহলে আরো ২৪ শতাংশ আমাদের এখানেই পাওনা হয়ে গেছে৷ এখন যদি সরকার বলে চলতি বছরে যে মূল্যস্ফীতি সেই পরিমাণ দেয়া হবে, তা হলে তো আমাদের প্রতি সুবিচার করা হবে না৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আমরা অপেক্ষায় আছি৷ প্রধানমন্ত্রী বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তৃতায় হয়ত পরিষ্কার করবেন আমাদের কত কী দেয়া হবে৷’’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘‘পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন যা মূল্যস্ফীতি এটা দেখে প্রধানমন্ত্রী সাময়িক ক্ষতিপূরণ ভাতা দেয়ার কথা বলেছেন৷ কারণ, অন্য কোনো পদ্ধতিতে দিলে সেটা স্থায়ী হয়ে যায়৷ এখন এটা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ৷ কীভাবে দেবে তা তারা ঠিক করবে৷’’
কিন্তু যারা সরকারি চাকরি করেন না তাদের সরকার কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷ এই যেমন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিয়ে পেঁয়াজের দাম কমানো হয়েছে৷ আরো পণ্যের ক্ষেত্রে এটা করা হবে৷ তবে ডলার সংকট না কাটলে অনেক কিছুই করা যাবে না৷ উপায় নেই৷’’
তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতি না কমাতে পারলে বেতন বাড়িয়ে কোনো সমাধান হবে না৷ আর সরকার কৃচ্ছতা সাধনের চেষ্টা করছে৷ কিন্তু আমাদের যা স্বভাব তা তো সহজে বদলায় না৷’’
এবার বাজেটে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা আরো বাড়ানো হয়েছে৷ সারচার্জ সীমা তিন কোটি থেকে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে৷ পাশাপাশি টিআইএন-ধারীদের মধ্যে যাদের কোনো করযোগ্য আয় নেই তাদেরও রিটার্ন সাবমিট করতে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা দিতে হবে৷ কর দেয়ার যোগ্যদের করের আওতায় না এনে, কর ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, বাজেটে ইনডাইরেক্ট ট্যক্স (যেমন: ভ্যাট) বাড়ানো হচ্ছে৷ এই ট্যাক্স ধনী-গরিব সবাইকে সমান হারে দিতে হয়৷
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘এবার বাজেটে যেভাবে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে, তাতে সাধারণ মানুষ করের ভারে পিষ্ট হবে৷ মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে৷ বাজেটে এটা কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেই৷ সরকার এখন বাজটের বাইরে গিয়ে সরকারি চাকুরেদের বেতন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ভিন্ন উপায়ে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য তো কিছু করা হয়নি৷ তাদের তো বেতন বাড়বে না৷ তাহলে তারা চলবে কীভাবে? কৃচ্ছতাসাধন তাহলে কার জন্য?’’
তার কথা, ‘‘আমার ধারণা, রাজনৈতিক কারণে সরকার সরকারি চাকুরেদের ভিন্ন উপায়ে বেতন বাড়াতে যাচ্ছে৷ হয়ত সামনে নির্বাচন তাই তাদের খুশি রাখতে চাইছে৷ কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে৷ সরকার যদি মূল্যস্ফীতি কমানোর ব্যবস্থা করতো, তাহলে সবার লাভ হতো৷ সবাই স্বস্তি পেতো৷’’
সিপিডির ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশে বছরে কোটি টাকা আয় করেন এমন জনগোষ্ঠীর ৬৭ শতাংশ কর আওতার বাইরে আছেন৷ তারা সারা দেশেই ছড়িয়ে আছেন৷ কিন্তু তাদের করের আওতায় আনা যাচ্ছে না৷
অন্যদিকে বাংলাদেশের শীর্ষের ১০ ভাগ লোকের হাতে জাতীয় আয়ের ৩৫ ভাগ৷ তারা যদি কমপক্ষে ১০ শতাংশ করও দেন, তাহলে জিডিপির অনুপাতে ৩.৫ শতাংশ কর সেখান থেকে আসার কথা৷ কিন্তু সেটা আসছে না৷
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘আমাদের পুরো কর কাঠামোর কারণেই সাধারণ মানুষ পিষ্ট হচ্ছে৷ ধনীদের একটি বড় অংশ, যারা কর দিতে সক্ষম, তারা কর দেয় না বা কর কম দেয়৷ তার কর ফাঁকি দেয়৷ যাদের সম্পদ ও আয় বেশি, তারা বেশি কর দেবে ৷ এটাই ন্যায়সঙ্গত কর ব্যবস্থা৷ কিন্তু এখানে তার উল্টো৷ আমাদের ইনডাইরেক্ট টাক্স তো ধনী যা দেয় গরিবও তা দেয়৷ এটা তো হতে পারে না৷’’
এই পরিস্থিতিতে সরকারি কর্মচারিদের বেতন বাড়ানো কোনো সমাধান আনবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘সরকারি কর্মচারীরা আমাদের শ্রম বাজারের পাঁচ ভাগেরও কম৷ তাদের বেতন বাড়লে বাকি ৯৫ ভাগ কী করবে? মূল্যস্ফীতি সরকার যা বলছে তার চাইতে অনেক বেশি৷ মজুরি বাড়ার হার তার তুলনায় অনেক কম৷ কিন্তু বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি৷ এবার বজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া দরকার ছিল মূল্যষ্ফীতির৷ সরকার হয়ত সামনের চাপ সামলাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করতে, বাজেটের বাইরে গিয়ে কোনো একটা প্রক্রিয়ায় তাদের বেতন বাড়াচ্ছে৷ কিন্তু ব্যক্তিখাত বা শ্রম বাজারে যারা আছেন, তাদের কী হবে? তারা বেতন বাড়ানোর কথা বললে তো চাকরিও চলে যেতে পারে৷ তাই সবাইকে স্বস্তি দিতে হলে মূল্যস্ফীতি কমানোর কোনো বিকল্প নেই৷’’
তার কথা, ‘‘মূল্যস্ফীতির অনেকগুলো কারণ আছে, তার মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হলে তার প্রভাবেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে৷ যাদের বেতন বাড়বে, তারা হয়ত সেটা সামলাতে পারবে, কিন্তু যাদের বাড়বে না, তারা কী করবে?’’
প্রস্তাবিত বাজটে সরকারি চাকুরেদের আবাসন সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ছয় হাজার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে এবং পাঁচ হাজার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান আছে৷ এছাড়া সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান আবাসন সুবিধা ৮ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷
এর বাইরে আরো আট হাজার ৮৩৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও ৬৪ জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডরমেটরি ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবিত বাজেটে৷