1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বীরাঙ্গনাদের অধিকারের জন্য লড়ছেন মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী

৯ জানুয়ারি ২০১১

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলার পূর্ব আকাশে ওঠে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য৷ তবে মুক্তিযুদ্ধে শুধু যে পুরুষরাই অংশগ্রহণ করেন, তা নয়৷ এই যুদ্ধের সাফল্যের পেছনে রয়েছে নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সকলের ত্যাগ আর প্রচেষ্টা৷

https://p.dw.com/p/zv12
Shafina, Lohani, Female, Freedom, Fighter, Bangladesh, Sirajgonj, Liberation, War, 1971, বীরাঙ্গনা, অধিকার, লড়ছেন, মুক্তিযোদ্ধা, সাফিনা, লোহানী
মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানীছবি: Shafina Lohani

এমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী৷ ডাক নাম বেবী৷ প্রমত্তা যমুনা নদীর তীরবর্তী জেলা শহর সিরাজগঞ্জ৷ সেই সিরাজগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী লোহানী বংশে ১৯৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম সংগ্রামী নারী মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানীর৷ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই মাসের সন্তান কোলে নিয়েও স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে ওতপ্রোতোভাবে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন৷ প্রাণ বাজি রেখে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন৷ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সক্রিয় থেকেছেন যুদ্ধের নানা পর্যায় এবং অঙ্গণে৷ এমনকি অনেক সময় নিজ কৌশল আর বুদ্ধিমত্তায় পরাস্ত করেছেন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যদের৷

১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী৷ রয়েছেন রাজপথের আন্দোলনেও৷ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহ্বানে ড. নীলিমা ইব্রাহীমের নেতৃত্বে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন ও শতাধিক নির্যাতিত নারীর পুনর্বাসন করে আসছেন সাফিনা লোহানী৷ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে ধরলেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ বললেন, ‘‘আমার স্বামী, দেবর, শ্বশুর, সবাই মুক্তিযোদ্ধা৷ আমরা তখন গ্রামে গেলাম৷ দুই মাসের শিশুসন্তানকে বুকে ধারণ করেই আমি বিভিন্ন গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি৷ মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামে যেখানে ক্যাম্প করেছিল সেখানে তাদের সাথে থেকেছি৷ তাদের সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ দিয়েছি৷ তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি৷ মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করা, আহতদের সেবা শুশ্রুষা করা, তাদের অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহ করা এগুলো আমার কাজ ছিল৷ নয় মাস এই কাজগুলো করেছি এবং এই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণটা ছিল আমার অন্তরের অনুভূতি৷''

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হাতড়ে একটি বিশেষভাবে স্মরণীয় ঘটনার কথা জানালেন সাফিনা লোহানী৷ তিনি বলেন: ‘‘যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে আমার শ্বশুর বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে৷ তারা মাঝেমাঝে সেখানে আসতো এবং দেখা করতো৷ একদিন রাতে আমার স্বামী এবং প্রায় ১৬/১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা এসে আমাদের বাসায় রাতের খাবার খেয়েছে৷ তারা খেয়ে চলে গেছে৷ এসময় রাজাকার-আল বদররা পাক সেনাদের খবর দিয়েছে যে, এই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা আছে৷ আমি আর বাড়ি থেকে সরে যায়নি৷ পাক সেনারা এসে বাড়ি ঘিরে ফেলে৷ বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়৷ সেই রাতে এতো গুলি যে আমি হতভম্ব হয়ে যাই৷ আমি শিশু সন্তানকে বুকে নিয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি৷ প্রচণ্ড গুলি হচ্ছে৷ এর মধ্যেই হঠাৎ করে আমার খেয়াল হয় যে, ঘরের মধ্যে চারটি চাইনিজ রাইফেল এবং এক ধামা গুলি রাখা আছে৷ সেগুলি রক্ষা করার জন্য আমি এক হাতে শিশু আর অন্য হাতে অস্ত্রগুলো নিয়ে ঘরের পেছনের খড়ের পালার মধ্যে লুকিয়ে রাখি৷ এরপর পেছনে সরে যেতে গিয়ে একটা গর্তে পড়ে যাই৷ গর্তে পড়ার ফলে আমার শিশু আমার হাত থেকে ছুটে যায়৷ আমি আর আমার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ আমি ভাবছি গর্তের পানিতে হয়তো আমার শিশু ডুবে গেছে৷ কিন্তু সেসময় আমাদের বাসায় যে কাজের মেয়ে ছিল সে বলছে আপা চিন্তা করেন না, আমি এখানে আছি৷ বলেই সে পানি থেকে আমার ছেলেকে খুঁজে উদ্ধার করেছে৷ সেইদিন যে আমি নিজেকে, ছেলেকে এবং অস্ত্রগুলো বাঁচাতে পেরেছি, এটা আমার সবসময় মনে পড়ে৷''

Shafina Lohani
সাফিনা লোহানীছবি: Shafina Lohani

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আওয়ামী লীগের সংগঠক স্বামী আমিনুল ইসলাম চৌধুরী কারারুদ্ধ হওয়ার পরে দীর্ঘদিন দুঃসহ জীবন কাটিয়েছেন, তবুও জীবন সংগ্রামের কাছে কখনও হার মানেননি এই বীর নারী৷

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও সেই চেতনা থেকে একটুও সরে দাঁড়াননি সাফিনা৷ সামাজিক সংগঠন সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও '৭১ এর নির্যাতিত নারীদের লালন ও তাদের সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজ করে যাচ্ছেন৷ বীরাঙ্গনা মায়েদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি৷ যেসব বীরাঙ্গনা নারী তাঁদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এনেছেন বাংলার স্বাধীনতা তাঁদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতিসহ অন্যান্য সকল সুবিধা প্রদানের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানালেন এই ত্যাগী বীর সেনানী৷

প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই

সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী