1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিয়ের কার্ডে টয়লেটের ছবি!

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ভারতের গ্রামে ‘লোটা-পার্টি’র ভরসায় দিন কাটে যে নারীদের, তাঁদের ‘টয়লেট এক প্রেম কথা’ মুভি নতুন দিশা দেখিয়েছিল৷ বাস্তবে মুর্শিদাবাদের সামসাল বেগম বিয়ের কার্ডে শৌচাগারের ছবি ছাপিয়ে মহিলাদের আত্মসম্মানবোধের বার্তা দিলেন৷

https://p.dw.com/p/34PEc
সামসাল বেগমের বিয়ের কার্ডে টয়লেটের ছবিছবি: DW/P. Samanta

নির্মল গ্রাম গড়ার লক্ষ্যে

অক্ষয় কুমার-ভূমি পেডনেকর অভিনীত ‘টয়লেট এক প্রেম কথা’ সিনেমাটিতে সদ্যবিবাহিতা শিক্ষিতা জয়া দলবেঁধে পাড়ার মেয়ে-বউদের সঙ্গে (লোটা-পার্টি) খোলা স্থানে প্রাতঃকৃত্য সারার লজ্জা থেকে মুক্তি পেতে শ্বশুরবাড়িই ছেড়ে দিয়েছিলেন৷ দীর্ঘদিন ধরে চাপিয়ে রাখা জগদ্দল ভাবনাটা কেবল সিনেমাতেই নয়, উপড়েছে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন থেকেও৷ মুর্শিদাবাদের বড়ঞা পঞ্চায়েত সমিতি কার্যালয়ে ঢোকার মুখেই পলাশ ঘোষের নির্মল চায়ের দোকান৷ ফেস্টুনে বড় বড় করে লেখা, ‘‘খোলা স্থানে মলত্যাগ করলে এই দোকানে চা পাওয়া যাবে না৷’’ চায়ের দোকান নির্মল করার উদ্দেশ্য কি জানতে চাওয়ায় তিনি বলছিলেন, ‘‘বিডিও, জয়েন্ট বিডিও পঞ্চায়েতকে নির্মল বানানোর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করছেন৷ আমি তাই এভাবে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ এতে অনেকে রাগারাগি করেছেন, অনেকে আবার নিজের ভুল বুঝতে পেরে শৌচালয়ও তৈরি করেছেন৷’’ বড়ঞাতেই ‘নির্মল সেলুন’-এ ছড়া লেখা ফেস্টুন ঝুলিয়েছেন এককড়ি দাস, ‘‘চুল দাড়ি কাটবো বারবার, যদি থাকে বাড়িতে শৌচাগার৷’’ তাঁর কথায়, ‘‘চুলদাড়ি কাটা যেমন সৌন্দর্যের ব্যাপার, তেমনি শৌচাগার থাকলেও পরিবেশ সুন্দর হবে, মেয়েদেরও ইজ্জত বাড়বে৷’’ 

India Westbengalen - Frau besteht auf vorhandene Toilette im Haus Ihres zukünftigen Ehemanns
সামসাল বেগম ও তাঁর বরছবি: DW/P. Samanta

এই বড়ঞার একঘরিয়া গ্রামেই ৩০শে আগস্ট নির্মল বিয়ে অনুষ্ঠিত হলো৷ এই বিয়ে ইতিমধ্যে সারা গ্রামে আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ পাত্রী উচ্চমাধ্যমিক পাস সামসাল বেগম নিতান্ত দারিদ্র্যের কারণেই কলেজে যেতে পারেননি৷ কিন্তু তিনি সচেতন নাগরিক হিসেবে বিয়ের কার্ডে শৌচাগারের ছবি ছেপেছেন, সে জন্যই তাঁর বিয়েতে প্রশাসনিক স্তরের আধিকারিকদের উপস্থিতিতে তাঁর বিয়ে আক্ষরিক অর্থে ‘নির্মল শুভ বিবাহ’ হয়ে উঠেছে৷ 

ভারতে টয়লেটের অভাব, তাই...

শৌচাগার যখন ‘ইজ্জতঘর’

প্রিয়াঙ্কা ভারতীর কথা সারা দেশ জানে৷ শ্বশুরবাড়িতে শৌচাগার না থাকায় তিনি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন৷ সামসাল প্রিয়াঙ্কার এই পদক্ষেপকে সমর্থন করেন৷ কারণ, শৌচাগারের ব্যাপারে সামসাল খুব একবগ্গা৷ প্রায় দু বছর ধরে গ্রামের নজরদারি টিমে মল্লিকা দাস, লায়লা বেগম, স্মৃতি দে, সালমা বেগম, রাজিয়া খাতুনের মতো সামসালও প্রতিদিন ভোরবেলা সবাইকে সচেতন করতে বেরিয়ে পড়েন৷ কখনো ককনো বাঁশিও থাকে সঙ্গে৷ কাউকে ঝোঁপেঝাড়ে, আড়ালে-আবডালে খোলা স্থানে মলত্যাগ করতে দেখলে সামসালের দল সাবধান করেন৷ ‘গান্ধীগিরি’র মতো করে কখনো মলত্যাগের অপকারিতা বোঝান, বা কখনো শুধু নীরবে দেখে যান৷ তাই আশেপাশের অনেকের অভ্যেসই অনেকটা পাল্টেছে৷ এ জন্য প্রশাসনের তরফে সামসালকে ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছে৷

সামসাল বলেন, ‘‘ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না৷’’ সামসালের নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, গ্রামের শৌচাগারসম্পন্ন দ্বিতল পাকাবাড়ির মানুষেরাও খোলা স্থানে মলত্যাগ করতে পছন্দ করতেন৷ তাঁদের বোঝাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে৷ অনেকে সামসালের বাড়িতে প্রতিবাদও জানাতে এসেছে এই নজরদারির৷ নজরদারি টিমের হীরা গাঙ্গুলি, পূর্নিমা দাস বা টোটান সূত্রধর গ্রামবাসীর হাতে এ জন্য প্রহৃতও হয়েছে৷ সামসাল বলেন, ‘‘তা-ও আমরা থামিনি৷ আশেপাশের সবাইকে জানিয়েছি শৌচাগারের বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ৷’’ তাই শৌচাগার সামসালের কাছে ‘ইজ্জতঘর’৷

মেয়েদের সম্মান থাকাটা খুবই জরুরি: সামসাল বেগম

বাস্তবের ‘টয়লেট এক প্রেম কথা’

অখ্যাত একঘরিয়া গ্রামের সেল্ফ হেল্প গ্রুপের সামসাল বেগম সিনেমাটি দেখেননি৷ নিজের বোধবুদ্ধি থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শৌচাগার সম্পন্ন বাড়িতেই বিয়ে করবেন৷ তাই কি বিয়ের কার্ডেও শৌচাগারের ছবি? এ প্রসঙ্গে সামসাল ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘মেয়েদের সম্মান থাকাটা খুবই জরুরি৷ আশেপাশে এতদিন বুঝিয়েছি৷ তাই এবার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদের এর গুরুত্ব বোঝাতে কার্ডে শৌচাগারের ছবির কথা মাথায় আসে৷’’

পাত্র যদি রাজি না হতেন? সামসাল বলেন, ‘‘বিষয়টা তখন ভেবে দেখতাম৷ উনি রাজি না হলে আমার আপত্তি থাকত৷ তবে উনি রাজি হয়েছেন৷’’ আদতে তিনি মনে করেন, রোগজীবাণু, দূষণ থেকে বাঁচতে যেমন খোলাস্থানে মলত্যাগ করা উচিত নয়, তেমনি মেয়েদের সম্মান রাখতেও শৌচালয় খুবই দরকারি৷ আর তাই বিয়ের কার্ডেও ছেপেছেন শৌচাগারের ছবি৷ পাশের গ্রাম পাঠানপাড়ার পাত্র তাউসেফ রেজা আহমেদও এই কাজে বাধা দেননি৷ আর বিয়েতেই বড়ঞার যুগ্ম বিডিও শ্যামলকান্তি শিকারির সামনে নবদম্পতি অঙ্গীকার করলেন নির্মল বাংলা গড়ার৷ সামসাল ভবিষ্যতে নজরদারির কাজ চালিয়ে যাবেন৷ বিয়ের আসরে নববধূ সাজে তিনি বললেন, ‘‘এখন এখান থেকে চেষ্টা করেছি৷ এবার শ্বশুরবাড়ি থেকেও নির্মল বাংলার প্রচারের চেষ্টা করব৷ অবশ্যই স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে৷’’

সামসাল সবার দৃষ্টান্ত

স্বচ্ছ ভারত অভিযানে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রত্যেকের বাড়িতে শৌচাগার তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে৷ স্বচ্ছ ভারত মিশনের অধীন গ্রামীন শৌচাগার সংক্রান্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৩ শতাংশ পরিবারে শৌচাগার আছে৷ এবং তারা এই শৌচাগার ব্যবহার করছে৷ ৬,১৩৬টি গ্রামে ও ৯২ হাজার ৪০টি পরিবারের উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছিল৷ ২০১৪ সালে স্বচ্ছ ভারত মিশন শুরু হওয়ার পর খোলা জায়গায় মলত্যাগের প্রবণতা কমেছে৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ৪ বছরে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষ খোলা স্থানে মলত্যাগ বন্ধ করে শৌচালয় ব্যবহার করছে৷ পশ্চিমবঙ্গেও ‘মিশন নির্মল বাংলা’ উদ্যোগের আওতায় শৌচাগার ব্যবহারে মানুষকে আগ্রহী করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷কিন্তু তার পরেও এখনো এই ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’তে এই কাজ অনেকটাই বাকি৷ এখনো অভ্যেসবশে অনেকে মাঠেঘাটেই যেতে পছন্দ করেন৷ আবার সচেতনতার অভাবে অনেক বাড়িতেই শৌচাগার নেই৷

রাজ্যের এই ছবিটার বিপরীতে বিয়ের কার্ডে ‘ইজ্জতঘর’-এর ছবি ছাপানোয় সুবিধাই হয়েছে জেলা আধিকারিকদের৷ এমনিতেই মুর্শিদাবাদকে নির্মল জেলা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রশাসনের উদ্যোগের অভাব নেই৷ সেখানে সামসাল নিজেই উদ্যোগ নিয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন৷ বিয়েতে উপস্থিত যুগ্ম বিডিও শ্যামলকান্তি শিকারি ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘মানুষের বদভ্যাস পরিবর্তন করা খুব কঠিন৷ ৩ থেকে ৫ শতাংশ মানুষ এখনো পুরানো অভ্যেস বদলাতে পারেননি৷ নজরদারির আড়ালেও তাঁরা এ কাজ করে যাচ্ছেন৷ প্রথমে যখন প্রশাসনিক দায়িত্ব নিয়ে এখানে আসি, তখন ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষই বাইরে যেতেন৷ আজ মুর্শিদাবাদ মুক্তি পেয়েছে মেয়েদের জন্য৷ সেল্ফ হেল্প গ্রুপের মেয়েদের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে৷ সামসালের এই উদ্যোগ এ কাজের সাফল্যকে আরো বাড়াবে৷ সামসালের পদক্ষেপ হয়ে উঠেছে দৃষ্টান্ত৷’’ সাহসী ও সচেতন সামসালের বিয়ের বাসরে এই আধিকারিক প্রচার করতে ছাড়েননি৷ আমন্ত্রিতদের হাতে বিলি করেছেন লিফলেটও৷

এসব দেখে নির্মল বিয়ের পাত্র তাউসেফ রেজা আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘যখন থেকে বিয়ে ঠিক হয়েছে, তখন থেকেই সামসালকে সাহায্য করে এসেছি৷ বলেছি, ভালো করে কাজ করো৷ ভবিষ্যতেও সাহায্য করবো৷ মিশন নির্মল বাংলায় প্রচারের কাজ করবো৷’’

প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...