জার্মানির পররাষ্ট্রনীতি
১০ ফেব্রুয়ারি ২০১২পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলে বিশ্বায়িত দুনিয়ার পরিবর্তনকে ‘‘দ্রুতগতি'' এবং ‘‘রুদ্ধশ্বাস'' বলে বর্ণনা করেছেন৷ এমন সব দেশ, যাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এক দশকের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে ওঠে; চীন যেখানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায়; আন্তর্জাতিক রাজনীতির মঞ্চে নতুন নতুন অভিনেতা দেখা দেয়: সে-বিশ্বে জার্মান পররাষ্ট্রনীতিকেও এই বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে৷ ভেস্টারভেলে'র ভাষ্য:
‘‘আমাদের কৈশোরের উন্নয়নশীল দেশগুলি আজ জি-টোয়েন্টির গোলটেবিলে একই মর্যাদা নিয়ে বসে - এবং তাদের অনেক কিছু বলার এবং দেওয়ার আছে৷ ব্রাজিল ইত্যবসরে ব্রিটেন'কে ছাড়িয়ে গেছে৷ উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলির কাছে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আছে, শিল্পোন্নত দেশগুলির কাছে তা নেই৷ বর্তমানে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটা প্রধান অংশ আসছে ঐ দ্রুত উপরে উঠে আসা দেশগুলির কাছ থেকেই৷ আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও দেশের পক্ষে এর তাৎপর্য কি, সেটাই হল এই নীতি-নির্ধারণী পত্রের বিষয়৷''
৬০ পাতার দলিলটি তৈরি হতে সুদীর্ঘ ১৮ মাস সময় লেগেছে, কেননা একাধিক মন্ত্রণালয় এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ কাজেই দলিলের বিভিন্ন আঙ্গিক ইতিমধ্যেই বাস্তব রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে, বলে ভেস্টারভেলে উল্লেখ করেন৷ বার্লিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বিশ্ব সভাকক্ষে' দলিলটি জনসমক্ষে উপস্থাপন করা হয়৷ সে সভায় বিশ্বের বহু দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন৷ এই প্রথম জার্মান সরকার পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে একটি যৌথ নীতি-নির্ধারণী পত্র পেশ করলেন৷ তাছাড়া জার্মানি ভবিষ্যতে সহযোগী দেশ হিসেবে কেমন হবে, সেটাও অন্যদের জানা দরকার৷ ভেস্টারভেলে বললেন:
‘‘উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলিকে আমরা শুধু শিল্পোন্নত হয়ে ওঠার মুখে, এমন দেশ বলে বিবেচনা করি না৷ তারা নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার শক্তি৷ তাদের মধ্যে অনেকেই রাজনীতি এবং সংস্কৃতির বিচারে নতুন শক্তিকেন্দ্র হয়ে উঠেছে৷ তারা দায়িত্ব নিচ্ছে এবং সঠিক কারণেই আন্তর্জাতিক রাজনীতির আরো বেশি রূপায়ণের অধিকার দাবি করছে৷ জার্মানির চিন্তাধারা হল: যে বিশ্বায়নকে রূপায়িত করতে চায়, তার শক্তিশালী সহযোগীর প্রয়োজন পড়বে৷''
এই সহযোগিতা থেকে সব পক্ষই লাভবান হবে, বলে ভেস্টারভেলে মন্তব্য করেন৷ শিক্ষা থেকে পরিবেশ নীতি ও নিরাপত্তা অবধি সব ক্ষেত্রেই সহযোগিতার প্রস্তাব দেন তিনি৷ জার্মানি ইউরোপের বিচারে অপেক্ষাকৃত বড় হলেও, বিশ্বের আঙ্গিকে অপেক্ষাকৃত ছোট, বলেন ভেস্টারভেলে৷ সহযোগিতার পূর্বশর্ত হল এই উপলব্ধি যে, ‘‘পশ্চিমা দুনিয়া আর একা বিশ্ব রাজনীতিকে পরিচালনা করছে না'', এবং পশ্চিমকে খানিকটা ক্ষমতা ছাড়তে হবে৷
কিন্তু তত্ত্ব এক, আর বাস্তব এক৷ জাতিসংঘকে দেখলেই তা বোঝা যায়৷ বহু বছর ধরে দক্ষিণ অ্যামেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার দ্রুত উত্থানশীল শক্তিরা বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদে বর্ধিত কণ্ঠ, এবং বর্ধিত ভূমিকা দাবি করে আসছে৷ কিন্তু ক্ষমতাধর ভেটো শক্তিরা তাদের বারংবার নিরাশ করেছে৷ অপরদিকে উত্থানশীল দেশ যতো বেশি হবে, ততো বেশি সংঘাতের সম্ভাবনা, বলে বার্লিনের প্রখ্যাত গবেষণা কেন্দ্র স্টিফটুং উইসেনশাফ্ট উন্ড পলিটিক'এর প্রধান ফোল্কার পের্থেজ মনে করেন:
‘‘আমাদের ধীরে ধীরে বুঝতে হবে যে, উত্থানশীল শক্তিরা বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হলে আমাদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু এবং মিত্রদেশগুলির কেউ কেউ বিশেষ সুখী হবে না৷''
কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সূত্রে বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্যদেশ অথবা জি-এইট গোষ্ঠী বিশ্ব শাসন করতে পারবে না, বলে পের্থেজ মনে করেন৷ বিশ্বব্যাপী সমস্যাগুলো এতই দুরূহ যে তার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নতুন জোট সৃষ্টির প্রয়োজন পড়বে৷ তার অর্থ এই নয় যে, পুরাতন জোট-সহযোগিতা ও বন্ধুত্বগুলি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে: ভেস্টারভেলে সেটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন৷ অপরদিকে ‘‘উত্থানশীল শক্তিদের কেউই আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে নেই,'' সেটাও জানেন তিনি৷
প্রতিবেদন: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক