বিশ্বকাপে তারা জ্বলে, তারা নেভে
৭ জুলাই ২০১৮২০১৮ বিশ্বকাপও এর ব্যতিক্রম হবে কী করে! রাশিয়ার টুর্নামেন্টও যথারীতি তারায় তারায় খচিত৷ এবং যথারীতি সময়ের আগেই সবচেয়ে বড় দুই তারকার পতন৷ লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর৷ আগামীর দুই মহাতারকার পদধ্বনির মাদলও বাজিয়ে চলেছে এ আসর৷ নেইমার ও কিলিয়ান এমবাপের৷ কিংবদন্তিদের বিদায়ের পথে আঁকা হচ্ছে যেন নতুনের আগমনের সুর৷
সমকালীন ফুটবলে সবচেয়ে বড় দুই কিংবদন্তি মেসি-রোনাল্ডো৷ মহাকালীন ফুটবলেও তাঁদের অবস্থান সুনিশ্চিত৷ কিন্তু আলোচনা যখন হবে সেরাদের সেরা নিয়ে, তখন বিশ্বকাপের প্রসঙ্গ না এসে পারে না৷ ঠিক এখানটাতেই এসে হোঁচট খায় আড্ডা৷ এখানে যে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দী হয়ে যান সমব্যথী সহচর! ক্যারিয়ারে তাঁদের এত প্রাপ্তি, তবু বিশ্বকাপ রয়ে গেল অতৃপ্তির অন্য নাম৷ সাফল্য-পুরষ্কারে এত পূর্ণতা, শূন্যতার হাহাকার থাকলো কেবল এই টুর্নামেন্ট ঘিরে৷ রাশিয়ার আসরের শেষ সুযোগটিও কাজে লাগাতে পারেন না আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের দুই ফুটবল জাদুকর৷
দু'জনের প্রথম বিশ্বকাপ ২০০৬ সালে৷ জার্মানির সেই আসরের সময় রোনাল্ডোর বয়স ২১ বছর, মেসির ১৯৷ পর্তুগালের হয়ে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠেছিলেন প্রথম জন; সেখানে ফ্রান্সের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ৷ রোনাল্ডো নিজে সেবার ছয় ম্যাচে মাত্র এক গোল করেন ৷ অন্যদিকে আর্জেন্টিনার জার্সিতে তিন ম্যাচে মেসিরও এক গোল৷ তাঁর দলের পথচলা থেমে যায় আরো আগে; কোয়ার্টার ফাইনালে৷ জার্মানির বিপক্ষে সে ম্যাচে কেন যে খুদে জাদুকরকে মাঠেই নামালেন না কোচ হোসে পেকারমান!
পরের চার বছরে ফুটবলবিশ্বে ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের সাম্রাজ্যে পালাবদল ঘটে গেছে৷ ফিফার বর্ষসেরা ও ব্যালন ডি'অর জেতা হয়ে গেছে রোনাল্ডো-মেসি দু'জনেরই৷ আর তা ক্লাব সাফল্যের সূত্রে৷ জাতীয় দলের গল্পটি একই থেকে গেছে৷ তাই তো বিশ্বকাপে পর্তুগাল মুখ থুবড়ে পড়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে; আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালে৷ সেবার চার ম্যাচে এক গোল রোনাল্ডোর; পাঁচ ম্যাচে গোলই পাননি মেসি৷
সময়ের চক্করে পেরিয়ে যায় আরো চার বছর৷ বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারে না কেউ৷ কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপেও যে আক্ষেপের গল্প ফুরোয় না! সেবারের কষ্টটা বেশি মেসির৷ সাত ম্যাচে চার গোল করে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন৷ কিন্তু সেখানে অতিরিক্ত সময়ে জার্মানির মারিও গ্যোটসের গোলে হৃদয় ভাঙে তাঁর৷ তিন ম্যাচে এক গোল করা রোনাল্ডোর পর্তুগাল বিদায় নেয় প্রথম রাউন্ডেই৷
আর এবার তো তাঁদের বিদায় গলাগলি করে৷ শেষ ষোলোর ম্যাচে ফ্রান্সের কাছে আর্জেন্টিনার হারের ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই উরুগুয়ের কাছে হেরে যায় পর্তুগাল৷ সমান চার ম্যাচ খেলে চার গোল রোনাল্ডোর আর মাত্র এক গোল মেসির৷ আর কখনো বিশ্বকাপ জয়ের সুযোগ হয়তো পাবেন না তাঁরা৷ কেননা, ২০২২ বিশ্বকাপ আসতে আসতে মেসির বয়স হয়ে যাবে ৩৫ বছর; রোনালল্ডোর ৩৭৷
বিশ্বকাপ আকাশ থেকে দুটো উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়তো খসে পড়ল চিরতরে৷
শুধু মেসি-রোনাল্ডো নয়, রাশিয়ার আসরে বিদায় হয়েছে আরো কত তারকার! স্পেনের আন্দ্রেসইনিয়েস্তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে স্বাগতিকদের কাছে দ্বিতীয় রাউন্ডের বিব্রতকর হারে৷ সের্হিয়ো রামোস, জেরার্দ পিকে, ইসকো, সের্হিয়ো বুসকেটসরা টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে ডুবলেন হতাশায়৷ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন জার্মানির মানুয়েল নয়ার, মেসুত ও্যজিল, সামি খেদিরা, মারিও গোমেজদের টুর্নামেন্ট তো শেষ হয়ে গেছে প্রথম রাউন্ডেই৷ আর্জেন্টিনার মেসি ছাড়াও হাভিয়ের মাসচেরানো, গনসালো হিগুয়েইন, সের্হিয়ো আগুয়েরোদের প্রতিভাবান প্রজন্মের পতন উল্কাপাতের মতো৷ গত বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতার 'গোল্ডেন বুট' জেতা কলম্বিয়ার হামেস রোদ্রিগেস, পোল্যান্ডের বরার্ট লেভান্ডোভস্কি, আর নতুন তারকার প্রতিশ্রুতি দেয়া মিশরের মোহামেদ সালাহ'রও বিদায় হয়ে গেছে৷
নতুন তারকার মিছিলে নেইমারের নাম শোনা যাচ্ছে বহু বছর ধরে৷ গত ১০ বছর ধরে মেসি-রোনাল্ডোর মাঝেই যেমন ভাগাভাগি বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার; এর অর্ধেক সময়জুড়ে তাঁদের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবা হয়েছে এই ব্রাজিলিয়ানকে৷ গত বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে বাজে ইনজুরিতে শেষ হয়ে যায় নেইমারের টুর্নামেন্ট৷ এবারও ক্লাব পাঁরি সঁ জার্মেইর হয়ে ফেব্রুয়ারিতে ইনজুরিতে পড়লে ফিরে আসে সেই শঙ্কা৷ তা তাড়িয়ে নেইমার ফিরেছেন; আর বিশ্বকাপের ম্যাচ যত গড়াচ্ছে, ততই বিস্ফোরক শ্রেষ্ঠত্বে প্রত্যাবর্তন হচ্ছে তাঁর৷
দুই মৌসুম আগে ধূমকেতুর মতো আচমকা আবির্ভাব কিলিয়ান এমবাপের৷ ক্লাবদলে আলো ছড়াচ্ছিলেন৷ আর বিশ্বমঞ্চে ফরাসি সৌরভ যে অনেকদিন ছড়াবেন, এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচে দুর্দান্ত খেলে সে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন৷ ফ্রান্স দলের সতীর্থদের মধ্যে গ্রিজমান এখনো সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি৷ তবে পল পগবা, এনগোলো কান্তেরা নিজেদের ছাপ রেখে চলেছেন ঠিকই৷ ব্রাজিলের হয়ে পারফরম্যান্স দিয়ে যেমন আলো নিজের দিকে টেনেছেন কুতিনিয়ো৷ বেলজিয়ামের রোমেলু লুকাকু, এডেন হ্যাজার্ড, কেভিন ডে ব্রুইনেরাও জানান দিচ্ছেন নিজেদের সামর্থ্যের৷ যেমনটা ইংল্যান্ডের হ্যারি কেন৷ ছয় গোল করে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়ে তিনি৷
এছাড়াও টাইব্রেকারে পেনাল্টি বাঁচিয়ে নায়ক বনে গেছেন রাশিয়ার গোলরক্ষক ইগর আকিনফিভ; ইংল্যান্ডের জর্ডান পিকফোর্ড৷ উরুগুয়ের এডিনসন কাভানি জোড়া গোল করে বিদায় করে দিয়েছেন পর্তুগাল ও রোনাল্ডোকে৷ রাশিয়ার ডেনিস চেরিশেভের খেলায় দেখা গেছে বহুদূর যাবার প্রতিশ্রুতি৷ আর নতুন তারকা হিসেবে আবির্ভূত স্বাগতিকদের আরেক মিডফিল্ডার আলেকসান্দার গোলোভিন৷ তবু দু'-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে সে অর্থে বিশ্বকাপে নতুন তারকার ছড়াছড়ি এবার সেভাবে নেই৷ সেই মেসি-রোনাল্ডোতেই ছিল সবচেয়ে বড় ভরসা; এখনকার বড় তারকা হয়ে টিকে রয়েছেন নেইমার-এমবাপে৷
বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ‘ডেইলি স্টার'-এর ক্রীড়া সম্পাদক মোহাম্মদ আল-আমিন রাশিয়া আছেন বিশ্বকাপ কাভার করার জন্য৷ মেসি-রোনাল্ডোর বিদায়ের জন্য তাঁদের দল ও কৌশলের দায় অনেকটাই দেখেন তিনি, ‘‘১৮ গজের ভেতর রোনাল্ডো বিশ্বসেরা স্ট্রাইকার; কিন্তু দল হিসেবে পর্তুগাল তত ভালো না৷ যদিও তারা ইউরো জিতেছে৷ তবে পর্তুগাল যেহেতু অত ভালো দল নয়, রোনাল্ডোর একার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়৷ আর মেসির ব্যাপার হচ্ছে, আর্জেন্টিনা দলের খেলা আবর্তিত হয় তাঁকে ঘিরে৷ এটি প্রতিপক্ষ জানে বলে তাঁকে আটকে রেখেছে৷ ফলে দলের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয়নি৷''
তিনি মনে করেন এ দুই তারকার জায়গা নেইমার-এমবাপে নেবেন কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনো আসেনি, ‘‘এমবাপের বয়স এখন ১৯ বছর৷ তাঁর আরো অনেক দূর যাওয়ার আছে৷ গতি ছাড়াও তাঁর খেলায় আরো অনেক গুণ দেখেছি৷ আর নেইমার হচ্ছেন এন্টারটেইনার৷ এখন মেসি-রোনাল্ডোকে নেইমার-এমবাপে প্রতিস্থাপন করবেন কিনা, এটি বলার জন্য সময়টা তাড়াতাড়ি হয়ে যায়৷ তবে আমি মনে করি, নেইমারের বিশ্বসেরা খেলোয়াড় হবার সম্ভাবনা রয়েছে৷''
বাংলাদেশের টেলিভিশন ‘চ্যানেল টোয়েন্টিফোর'-এর সিনিয়র রিপোর্টার রেজওয়ান উজ জামানও এখন রাশিয়ায়৷ চলতি বিশ্বকাপ কাভার করতে ছুটছেন ভেনু থেকে ভেনুতে৷ টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত শেষ; অমনভাবে নতুন তারকার দেখা পাননি৷ বাকি সময়ে পাবেন বলেও ভাবছেন না তিনি, ‘‘একক তারকার হিসেবে বলতে পারেন হ্যারি কেন ছয়টি গোল দিয়েছে৷ কিন্তু যদি বলেন পেলে, দিয়েগো মারাদোনা বা ক্লাব ফুটবলের কারণে মেসিকে যেভাবে বছরের পর বছর ফুটবল বিশ্ব মনে রেখেছে, অমন কারো কোনো পারফরম্যান্স এবারের বিশ্বকাপে হবে বলে আমার মনে হয় না৷ কারণ, ফুটবলটা এখন এত বেশি দলীয় খেলা হয়ে গেছে, এককভাবে কারো উপর কোনো কোচ নির্ভর করতে চান না৷ করলে কী অবস্থা হয়, সেটি মেসির আর্জেন্টিনার বেলায় আমরা দেখেছি৷ বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত অমন বড় ব্যক্তিগত নৈপুণ্য চোখে পড়েনি৷ শেষ দুই-তিন রাউন্ডে তা পাল্টে যাবে বলে মনে হয় না৷''
হাওয়া যদি পাল্টে যায় প্রবলভাবে, যদি নেইমার-এমবাপেরা প্রতিভার আলোয় ঝলসে দিতে পারেন বিশ্বকাপের শেষ ধাপগুলো, তাহলে এই বিশ্বকাপ হয়ে রইবে তাঁদের৷ নইলে এটি মেসি-রোনাল্ডোর হাহাকারের৷
আলফ্রেদো দি স্তেফানো, জর্জ বেস্টরা বিশ্বকাপ খেলেননি৷ ইয়োহান ক্রুইফ, জিকো, মিশেল প্লাতিনি, ফেরেঙ্ক পুসকাস, মার্কো ফন বাস্তেন, পাওলো মালদিনির মতো খেলোয়াড় বিশ্বকাপ জেতেননি৷ তবু সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের আড্ডায়, চা-কফির মগের ধোঁয়ায় ভেসে বেড়ায় তাঁদের নাম৷
মেসি-রোনাল্ডোর নামও থাকবে সেখানে৷ থাকতেই হবে৷ তাঁদের ফুটবলীয় সামর্থ্যে কুর্নিশ করবে মহাকাল৷ শুধু আড্ডায়-আলোচনায় বিশ্বকাপ পর্বটি আসবে যখন, বিষন্নতার এক চোরা দীর্ঘশ্বাস বয়ে যাবে সবার অজান্তেই৷ ক্যারিয়ারের সব প্রাপ্তির পরও এটি যে মেসি-রোনাল্ডোর জন্য সর্বহারার হাহাকার!