পাইলটদের বিষাদগ্রস্ত হবার কারণ
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬২০১৫ সালের মার্চে জার্মানউইংস-এর একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়৷ ঐ বিমানের কো-পাইলট আত্মঘাতী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন৷ তাই তিনি বিমানটিকে ফ্রেঞ্চ আল্পসে বিধ্বস্ত করেন৷ ঐ ঘটনায় প্রাণ হারান বিমানে থাকা দেড়শ' আরোহী৷ এই ঘটনাটি বিমানচালকদের মানসিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল৷
যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড স্কুল অফ পাবলিক হেল্থ'-এর ‘কর্ম পরিবেশে নিরাপত্তা এবং সুস্থ পরিবেশ' বিভাগের অধ্যাপক জোসেফ অ্যালেন এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন৷ ৩ হাজার ৫০০ পাইলটকে তাঁদের কাজের পরিবেশ নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল৷ তাঁদের মানসিক অবস্থা সম্পর্কে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে পেরেছিল অংশগ্রহণকারীদের মাত্র অর্ধেকভাগ৷
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা দেখেন, প্রতিযোগীদের ১২.৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্ণতার লক্ষণ রয়েছে৷ তাই পাইলটরা যে ঝুঁকির মুখে রয়েছেন, তা বলাই যায়৷ এদের মধ্যে ৪ শতাংশ গবেষণার সময় জানিয়েছে, গত দুই সপ্তাহে তাঁরা কয়েকবার আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভেবেছিলেন৷
তবে যেসব পাইলটদের জীবনে যৌন বা মৌখিক নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনা ঘটেছে তাঁদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি৷ গবেষণায় যেটা লক্ষ্যণীয় তা হলো পাইলটরা তাঁদের মানসিক অবস্থা নিয়ে কখনোই কথা বলেন না৷ ‘এনভার্নমেন্টাল হেল্থ' জার্নালে ১৫ ডিসেম্বর গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়৷
কাজের চাপ থেকে মানসিক সমস্যা
জার্মানির পাইলট ট্রেড ইউনিয়নের মুখপাত্র মার্কুস ভাল এই গবেষণার ফলাফলে বিস্মিত হয়েছেন৷ তিনি সরাসরি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি৷ তবে কেন পাইলটরা এ ধরনের বিষণ্ণতায় ভোগেন, তার কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন৷ ভাল-এর মতে, বিমানের পাইলটরা সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করেন, তাঁদের এক ভুল সিদ্ধান্তে অনেক মানুষের প্রাণ যেতে পারে, এই ভয় সব সময় তাঁদের মধ্যে কাজ করে৷ কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়৷ ফলে কর্ম পরিবেশে চাপ বাড়তে থাকে, আর এই চাপ একসময় মানসিক সমস্যায় রূপ নেয়৷
কাজ এবং পরিবার
কাজের দরুণ পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় পাইলটকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়৷ ২০ থেকে ২২ দিন তাদের কাটাতে হয় হোটেলে৷ তাই বন্ধুবান্ধব, সঙ্গী এবং পরিবার ছাড়া তাঁদের সময় কাটানো কঠিন হয়ে পড়ে৷ একদিকে কাজের চাপ, অন্যদিকে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা – তাই মানসিকভাবে তাঁরা অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলে৷ সে কারণে যখন তাঁরা কাজে থাকেন তখন পরিবারের নানা সমস্যা নিয়েও ভাবতে থাকেন৷ এমন কিছু পারিবারিক সমস্যা দেখা দেয়, যেখানে কেবল টেলিফোনে কথা বলে সমাধান সম্ভব নয়, তখন সেই দুশ্চিন্তা এবং বিষণ্ণতা নিয়েই বিমান চালাতে হয় পাইলটকে৷ আর সময়ের পার্থক্যও একটা বড় ব্যাপার৷ যে কারণে যখন হয়ত কথা বলা দরকার, তখন সম্ভব হয় না৷ আর সেই দুশ্চিন্তা পাইলটকে মানসিকভাবে আরো বিষাদগ্রস্ত করে তোলে৷
জার্মান পাইলট ট্রেড ইউনিয়নের ঐ মুখপাত্র আরও জানান যে, আগে বিমানের খুঁটিনাটি কিছু বিষয় দেখার জন্য ‘গ্রাউন্ড টেকনিশিয়ান' থাকতো৷ এখন সেই কাজটিও পাইলটদের করতে হয়৷ ছোট্ট একটা কাজ করার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্রে সই করতে হয়, যেমন বিমানের যদি একটা বাল্ব নষ্ট থাকে এবং সেই মুহূর্তে সেটা সারানো সম্ভব না হলে ফোনের মাধ্যমে তা কর্তৃপক্ষকে জানানো এবং নিশ্চিত করা যে এর ফলে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না৷ এমনকি বিমান চালকরা যখন নির্বিঘ্নে বিমান অবতরণ করেন, কোনো সহকর্মী বা অফিসের কেউ আজকাল আর তাঁদের বাহবা পর্যন্ত দেয় না৷ এই ছোট্ট একটু প্রশস্তি হয়ত তাঁর মানসিক চাপকে অনেকটাই কমিয়ে দিত৷ এমনকি ছুটির দিন যেমন ক্রিসমাসেও তাঁদের জন্য বিশেষ কোনো বার্তা থাকে না, যেমন ‘তুমি আসলেই দারুণ কাজ করেছো৷'
ভাল বলেন, ‘‘আগে ম্যানেজমেন্ট থেকে সরাসরি কেউ এসে বলতো ‘তুমি একদম ঠিক সময় অবতরণ করেছ, এ কারণেই ভোক্তারা আমাদের এয়ারলাইন্স পছন্দ করে৷’ কিন্তু বহু বছর হয়ে গেছে এখন আর এমন কেউই বলে না৷’’
প্রতিবেদন: ফাবিয়ান স্মিড্ট/এপিবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ