'বিফলে গীত অবসান?'
২৫ আগস্ট ২০২৩রবীন্দ্রনাথ 'বুড়া রাজা প্রতাপ রায়কে দিয়ে বলাচ্ছেন, "সেকালে গান ছিল, একালে হায়, গানের বড় অবহেলা!" কবিতার নাম 'গানভঙ্গ'। লেখাটি ১৩০০ বঙ্গাব্দের ১৪ ই আষাঢ়ে শিলাইদহ বোটে রচনা, অর্থাৎ আজ থেকে ১৩০ বছর আগে। তখনও কবির বর্ণনায় নবীন যুবা কাশীনাথের কন্ঠে কিন্তু সপ্তসুর সাতটি পোষা পাখির মত খেলে বেড়াচ্ছে! বোঝা যাচ্ছে যে, স্বাদ, রুচির পরিবর্তন বা মূল্যবোধের তুল্যমূল্য মতপার্থক্য থাকলেও রাজদরবারে তখনও গান আর না-গান একাসনে বসার মত পরিস্থিতি হয়নি।
কিন্তু এখন এই প্রযুক্তির শীর্ষে পৌঁছানো সমকালে সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। কাজী নজরুলের ভাষায় ''সেই আগ্রা সে দিল্লি ভাই আছে প'ড়ে, সে বাদশাহ্ নাই"। দুনিয়ার মজদুর এক না হলেও, দুনিয়ার গানওয়ালাকে এক হতে হয়েছে এক অবারিত ছত্রতলে। সে ছাতা হলো সোশ্যাল মিডিয়া। বঙ্গজীবনের অঙ্গ নানান 'তলা', যেমন বটতলা, ডুমুরতলা, ধর্মতলা, রথতলা ইত্যাদি সব তলা এখন এসে মিশে গেছে শেষে নেটতলাতে।
গানদুনিয়াই হয়েছে সাম্যবাদের সার্থকতম লীলাক্ষেত্র। রেডিওয় গান গাইতে গেলে অডিশনে পাশ করার বাধ্যবাধকতা ছিল। সরকারি টেলিভিশনের ক্ষেত্রেও ছিল যোগ্যতা বিচারের পরীক্ষাব্যবস্থা। তাতে উত্তীর্ণ হয়ে নামের আগে-পরে 'বেতার শিল্পী' বা পরবর্তীকালে 'বেতার ও দূরদর্শন শিল্পী' লাগিয়ে মানুষের কাছে মর্যাদা আশা করতে হতো শিল্পীদের। এখন রেডিওতে গান গাইলেও সেলফি তুলে পোস্টাতে হয় ফেসবুকে। টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের লিঙ্ক চ্যানেল কর্তৃপক্ষকেই ইউটিউবায়িত, ফেসবুকায়িত করতে হয় জনগণেশের দৃষ্টিপ্রসাদলোভে। তাই, অনেক রেওয়াজ করা, গানের উৎকর্ষ নিয়ে অনেক চিন্তা করা গবেষক আর নিজের গানের মান বা সুর-বেসুর নিয়ে ধারণাহীন নির্বিকারের আত্মপ্রকাশের মঞ্চ এখন এক ও একমাত্র সোশ্যাল মিডিয়া। গোবিন্দভোগ, বাসমতি, তুলাইপাঞ্জি আর রেশনে বিলি হওয়ার মানের চালের দোকান একটাই হলে তবু উপভোক্তারা গুণমান বিচারের ক্ষমতা রাখেন। ইলিশ আর ভোলা মাছের যথাযথ দর বা কদরও দিতে পারে সাধারণের রসনা। কিন্তু যে রস বিমূর্ত, তার স্বাদ গন্ধের নাগাল পেতে দরকার বোধের। এবং সেই সূক্ষ্ম বোধ চিরকালই দুষ্প্রাপ্য। তাই, হঠাৎ করে ভাইরাল হয়ে যাওয়া গান বা গানের মতো কিছু, ছেঁড়া কাঁথা থেকে সোনার পালঙ্কে নিয়ে গিয়ে ফেলে কারোকে।
গ্রাম্য ফেরিওয়ালার বিজ্ঞাপনী সুরেলা ছড়া হঠাৎ ফোনে ফোনেছড়িয়ে পড়ে তার জীবনে ক'দিনে এমন বদল এনে দেয়, স্বাভাবিক ভাবেই হুজুগ জুড়োলে পূনর্মূষিকভূত তিনি আর ফিরতে চেয়েও পারেননা তাঁর ফেরিওয়ালা জীবনে। রেলের প্ল্যাটফর্মে গান শুনিয়ে ভিক্ষে করা মানুষটি সোশ্যালমিডিয়ার জাদু-গালিচায় চড়ে হঠাৎ প্লে ব্যাকের ডাকে পৌঁছে যান বলিউডের মায়াজগতে। তারপর, কিছু মায়াই শুধু থেকে যায়, ছায়াচারিণী জীবন কাটে পুরোনো কঠিন বাস্তবে।
আসলে, ইদানীং কালের ভার্চুয়াল দুনিয়া যখন তখন জ়িরো থেকে হিরো ( বিশেষ কোনো 'আলম'-এর কথা বলছি না ) বানিয়ে দিতে পারে কারোকে, শুধু ভিউসংখ্যার কল্যাণে, তা সে ভিউ ভালো লাগার হোক বা না হোক। লোকমুখে ভালো কিছুর প্রশংসা শুনে আপনি যেমন তা দেখতে সেই লিঙ্কে ক্লিক করেন , কোনো কিছু নিয়ে খুব 'ছি ছি' শুনেও দেখতে চান, নিন্দিত যা তার নিন্দনীয় সঠিক কারণ। ফলে ভিউবিচারে জনপ্রিয়তা আর গণ-অপ্রিয়তা দুই-ই রেভিনিউ তুলে আনতে পারে একইভাবে। আর এতেই হয়েছে মুশকিল। মেধাসম্পন্ন মৌলিক কাজ লাইক শেয়ারের স্বল্পতায় নিরাশ হয়ে ভালো থেকে ভালগারে ঝুঁকে যাচ্ছে কখনো কখনো। গানের কথায় বা ভিডিওতে আদিম প্রবৃত্তির সুড়সুড়ির পথ নিতেও পিছ পা হচ্ছেন না কেউ কেউ, কখনো কখনো!
এখন প্রশ্ন হলো, ওপরে যা যা বলা হলো, তা যদি অবক্ষয় বলে ধরা হয়, সেই অবক্ষয় রুখে ঘুরে দাঁড়ানোর কি কোনো উপায় আছে আদৌ? মেধাহীনতা, নিম্নমেধা বা খুব বেশি করে বললেও মধ্যমেধার এই জয়োল্লাসে প্রকৃত সৃজনী মনন কি হেরেই যাবে বারবার? অথবা, জীবনে মালা না পাওয়া স্রষ্টা-শিল্পীর মরণেই জুটবে ফুল?
উত্তর তো দেবে উত্তরকাল। কিন্তু পাঠক বন্ধু, সংগীতের মনযোগী শ্রোতা আপনি, আপনারও কি দায় নেই ভাবীকালের সেই ঘুরে দাঁড়ানোর মিছিলের অগ্রপথিক হওয়ার?
চলুন না, আজ শপথ নেওয়া যাক, গানে শুধু বিনোদন নয়, জীবনবোধও খুঁজবো । শুধুমাত্র তালিতে তালি না মিলিয়ে তালের ছন্দের সুরের গহনেও ডুব দিতে চাইবো কিছুটা সময় খরচ করে।
তবেই, তো বাঁচবে গান।
ভবিষ্যতের গীতিকবিকে আর লিখতে হবে না,
"'কেহ শোনে না গান জাগে না প্রাণ
বিফলে গীত অবসান.."