বিদেশি চ্যানেল দেখা নিয়ে সংকট
৮ অক্টোবর ২০২১- যেসব নাম্বার টিপলে আগে বিদেশি চ্যানেল দেখা যেত এখন সেসব নাম্বারে সুইচ করলেই পর্দায় ভেসে উঠছে এই ঘোষণা৷ ১লা অক্টোবর থেকে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন বাংলাদেশের টেলিভিশন দর্শকেরা৷
এর পেছনে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার প্রণীত একটি আইন৷ ২০০৬ সালে কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক কার্যক্রম পরিচালনা এবং এর আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে ‘কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা আইন ২০০৬’- প্রণয়ন করা হয়৷ আইনের ১৯ নম্বর ধারায় সম্প্রচার ও সঞ্চালন ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ শিরোনামের উপধারা ১৩ নম্বরে স্পষ্ট করে লেখা আছে- কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য বিদেশি কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন সম্প্রচার বা সঞ্চালন করিতে পারিবে না৷’
২০০৬ সালের এই আইন এতদিন ধরে একরকম উপেক্ষাই করা হল৷ না সরকার, না কেবল অপারেটর, না অন্য কোন পক্ষ কেউ-ই আইন কার্যকর করতে ব্যবস্থা নেয়নি৷ শেষ পর্যন্ত ১৫ বছর পরে সরকার এই আইন বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হয়েছে৷ সরকারি নির্দেশনা মেনে বাংলাদেশের কেবল অপারেটররা বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান প্রচার করে- তেমন বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার বন্ধ রেখেছে৷
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, সরকার কোনো চ্যানেল বন্ধ করেনি, দেশের আকাশ উন্মুক্ত রয়েছে৷ আইন মেনে যে কোনো বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার করা যাবে৷
সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বিদ্যমান আইন অনুযায়ী বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠানবাংলাদেশে দেখাতে হলে তা বিজ্ঞাপনমুক্ত থাকতে হবে৷ যাকে বলা হচ্ছে ‘ক্লিন ফিড‘৷ ক্লিন ফিড ছাড়া বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার আইনের বরখেলাপ৷ কেউ যদি এই আইন ভঙ্গ করে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার করে তবে সরকারের তরফ থেকে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়েছে৷
আইনের বাস্তবায়নের পাশাপশি এখানে সরকারের রাজস্ব হারানোর বিষয়টাও সামনে আসছে৷ বিদেশি চ্যানেলে প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে সরকার কোন রাজস্ব পায় না ৷ আবার ওই সব চ্যানেল বাংলাদেশে জনপ্রিয় হওয়ায় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের পণ্য প্রচারের জন্য বিদেশি চ্যানেলকেই বেছে নেয়৷ ফলে দেশি চ্যানেলগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিজ্ঞাপনসহ অনুষ্ঠান চালানোর ফলে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বঞ্চিত হয়৷ ফলে সামগ্রিকভাবে দেশ, দেশি টিভি চ্যানেল ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরাও ক্ষতির সম্মুখীন হয়৷
এদিকে কেবল অপারেটররা বলছেন, বিদেশি চ্যানেলগুলো ক্লিন ফিড না দিলে বিজ্ঞাপন কেটে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ সে কারণে তারা চ্যানেলগুলো প্রচার করাই বন্ধ করে দিয়েছেন৷
এর ফলে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ দর্শকরা৷ দেশীয় চ্যানেলগুলোর বাইরে আর কোন চ্যানেলই দেখতে পারছেন না তারা৷ বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই চলছে ভারতীয় চ্যানেল স্টার জলসা, জি বাংলা, স্টার প্লাস, সনিসহ আরো কিছু বিনোদনভিত্তিক চ্যানেল৷ এক শ্রেণীর দর্শকের কাছে এই চ্যানেলগুলো বেশ জনপ্রিয়ও বটে৷ তবে চ্যানেল বন্ধে দর্শকদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷ কেউ কেউ ক্ষুব্ধ হয়েছেন৷ হতাশা প্রকাশ করেছেন৷ কেউ আবার সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলছেন, খুবই ভাল উদ্যোগ৷ এর মাধ্যমে দেশি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে, বিদেশি সংস্কৃতির বিজাতীয় আগ্রাসন থেকে আমরা মুক্তি পাবো৷ অনেকের মতে, ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো অবাস্তব, উদ্ভট ও অশালীন গল্পের সিরিয়াল প্রচার করে৷ যা সুস্থ সভ্য ভদ্র সংস্কৃতির বিরোধী৷ ফলে সরকারের সিদ্ধান্তকে সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত বলছেন তারা৷ এমনকি বিজ্ঞাপনমুক্ত হলেও দেশে এসব টিভি চ্যানেল না চালানোর পক্ষে অনেকে৷ তবে আল জাজিরা, বিবিসি, সিএনএন এর মতো আন্তর্জাতিক খবরের চ্যানেলগুলো বন্ধ রাখায় অবাধ তথ্য প্রবাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশংকাও করছেন অনেক দর্শক৷ বিদেশি স্পোর্টস চ্যানেলের বাংলাদেশী দর্শকেরাও তাদের নির্মল বিনোদনের মাধ্যম বন্ধ হওয়ায় হতাশ৷
তবে বিবিসি সিএনএনসহ ২৪টি বিদেশি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনমুক্ত ক্লিন ফিড আছে বলে তথ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন৷ কিন্তু অনেক অপারেটরই সেগুলো চালাচ্ছে না৷ যা কেবল অপারেটর লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ৷ সরকারের এই বক্তব্যের পর অবশ্য কিছু অপারেটর সরকার নির্ধারিত বিজ্ঞাপনমুক্ত চ্যানেলগুলো সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে৷
বাংলাদেশ সরকার বলছে, ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম সম্প্রচার আইন আছে৷ অন্য দেশগুলো যদি এই আইন সফলভাবে কার্যকর করতে পারে, তবে বাংলাদেশ কেন পারবে না?
এর উত্তরে কেবল অপারেটররা বলছে, এক্ষেত্রে তাদের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ তাদের মতে, ডিজিটালাইজেশন এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে৷ তাদের অবকাঠামো দুর্বল৷ অনুষ্ঠানকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করার প্রযুক্তিও তাদের কাছে নেই৷ আবার তেমন প্রযুক্তি সংগ্রহ করার কোন চেষ্টা বা আগ্রহও তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না৷ বরং চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েই তারা তাদের দায় সেরেছেন৷ এমনো বলছেন যে, সরকারের এই পদক্ষেপে সাধারণ মানুষ যদি কেবল লাইন নেয়া বন্ধ করে দেয় তাহলে অপারেটিং পেশায় জড়িত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়বেন৷
এদিকে এটাও সত্য যে, বিজ্ঞাপনের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশের প্রাইভেট টেলিভিশনগুলো দেশী বিজ্ঞাপনের সীমিত বাজারে বেশ খানিকটা সংকটের মধ্যেই আছে৷ এই অবস্থায় দেশের বিজ্ঞাপন বাইরের টেলিভিশন চ্যানেলে চলে যাওয়ায় তাদের সংকট আরো বাড়ছে৷ ফলে দেরিতে হলেও সরকার যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন বেসরকারি টিভির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা৷ যদিও প্রশ্ন আছে, বাইরের টিভিতে চলে যাওয়া বিজ্ঞাপনগুলো কি তাহলে এখন দেশীয় চ্যানেলগুলো পাবে? না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই৷ তবে এক্ষেত্রে দেশি টেলিভিশনগুলো হয়তো তাদের কনটেন্ট শক্তিশালী করে বিজ্ঞাপনদাতাদের আকৃষ্ট করতে মনোযোগী হবে৷
আসলে, কেবল অপারেটর, সরকার, বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল মালিকসহ সকল পক্ষকেই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করতে হবে৷ দেশের বাণিজ্যিক ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ দেখার পাশাপাশি দর্শকদের চাহিদার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে৷ এখন কিন্তু ফেসবুক, ইউটিউব ও ইন্টারনেটভিত্তিক আন্তর্জাতিক ভিডিও প্লাটফর্মগুলিতেও হাজার কোটি টাকার দেশীয় বিজ্ঞাপন চলে যাচ্ছে৷ টেলিভিশন চ্যানেলগুলো যদি নিজেদের অনুষ্ঠানের মান ও বৈচিত্র্য না বাড়ায়, যদি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়, তবে স্বাভাবিকভাবেই তারা বিজ্ঞাপন হারাবে৷ মানুষ বিনোদনের জন্য অনলাইন প্লাটফর্মের দিকে ঝুঁকলে বিজ্ঞাপনদাতারাও সেদিকে ছুটবেন৷ ফলে বৃহত্তর পরিসরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাবতে হবে৷