যে কারণে কুটির শিল্পে কর্মী কমছে
১০ জানুয়ারি ২০১৭‘‘যারা এই কাজ করে, তাদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে দালালরা৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাচ্ছে অনেকেই৷ বাইরে যাওয়ার জন্য এরা যেন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে৷ ফলে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বহু দক্ষ কর্মী আমরা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছি৷''
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে কথাগুলো বলছিলেন ‘নিডল ক্রাফট' নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তাজিমা হোসেন মজুমদার৷ জয়পুরহাট, বগুড়া, জামালপুর, সাভারসহ বেশ কিছু জায়গায় নারীদের দিয়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাজ করান তিনি৷ দুই থেকে তিনশ' নারী কাজ করেন তাঁর তত্ত্বাবধানে৷ এছাড়া তিনি নিজে কাজ করেন স্বেচ্ছাশ্রমে৷ বঞ্চিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যই তিনি এই কাজে এসেছেন৷ এই নারীদের ন্যায্যমূল্য পাইয়ে দেয়াই তাঁর প্রধান লক্ষ্য৷
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশে তো অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প৷ এগুলোর হিসাব সেভাবে নেই৷ মানে এই সেক্টরে একটা বিশৃঙ্খলা আছে৷ তা সেটা আপনি কীভাবে দেখেন?
তাজিমা হোসেন মজুমদার: হ্যাঁ, এই সেক্টরে একটা বিশৃঙ্খলা আছে৷ তবে সেটাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব৷ এখানে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের অধিকাংশই নারী৷ যার যেটাতে দক্ষতা সে সেটা নিয়ে কাজ করে৷ এটা দেশের প্রত্যেক এলাকাতেই হয়৷ তবে এদের অধিকাংশই কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে না৷ নিজে একটা জিনিস তৈরি করে সেটা বিক্রি করে, যেমন বগুড়ার টুপি খুবই বিখ্যাত৷
আপনারা যে কাজটা করেন, সেটা কীভাবে করেন?
আমার আসলে এ বিষয়ে আগে কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না৷ বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আমি ‘হাঙ্গার প্রজেক্টের' সঙ্গে যুক্ত হই৷ আমার স্বামী এই প্রজেক্টের বাংলাদেশের কো-অর্ডিনেটর৷ একসঙ্গে আমরা কাজ শুরু করি৷ তখনই অনেক নারী আমার কাছে আসে৷ তারা যে জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করে আমি সেগুলোর মান উন্নয়নে কিছু পরামর্শ দিই৷ তাদের ট্রেনিং করাই, কাপড় দেই, সুতা দেই যেন কাজটা ভালো হয়৷ একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করি আমি৷ তাদের প্রোডাক্টগুলোর মার্কেটিং শুরু করি৷ এক সময় বিদেশি বায়াররা ছিল, বিদেশে যেত তাদের প্রোডাক্ট৷ এখন অবশ্য বাইরে যায় না৷ দেশের মার্কেটেই এগুলো বিক্রি করা হয়৷ আগে তারা যেটা তৈরি করত, সেটা পরিশীলিত ছিল না৷ এখন তাদের তৈরি প্রোডাক্টগুলো অনেক ভালো মানের হয়৷
আপনার প্রোজেক্ট কোন এলাকায়?
রাজধানীর রায়েরবাজার বস্তিতে কাজ হয়৷ তারা সেখানে ‘ওয়াল হ্যাঙ্গার' তৈরি করে৷ তবে আমাদের সব কাজই দেশি প্রোডাক্ট৷ জয়পুরহাট, জামালপুর, বগুড়া, সাভারে আমাদের নারীরা কাজ করে৷ এই কাজগুলোর সঙ্গে অনেক নারী জড়িত৷
গ্রামের ঐ নারীরা যে প্রোডাক্টটা তৈরি করে, সেটা তারা কীভাবে বিক্রি করে? আপনার মাধ্যমে, নাকি নিজেদের উদ্যোগে?
আমার সঙ্গে যুক্ত নারীরা আমার মাধ্যমেই তাদের তৈরি করা জিনিস বিক্রি করে, কারণ, আমি তাদের কাপড় দেই, সুতা দেই, ডিজাইন দেই৷ তবে এই কাজগুলো যারা করে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু নিজ গৃহে কাজ শেষ করার পরে এই কাজ করে৷ তাদের কারো কিন্তু এটাই প্রধান কাজ না৷ তারা বাড়ির কাজ করার পর সন্তানদের দেখাশোনা করে৷ এরপর যদি কিছু সময় থাকে, তবে সেটা এই কাজে ব্যবহার করে৷ তাই তাদের একটা ‘প্রোডাক্ট' তৈরি করতে অনেক সময় লেগে যায়৷
এতে কি তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন?
আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তারা অবশ্যই ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে৷ এটা আমি বলতে পারি, কারণ, আমার প্রতিষ্ঠানের স্লোগান হলো ‘নট ফর প্রোফিট'৷ আমরা যে দামে প্রোডাক্টগুলো বিক্রি করি, আড়ং কিন্তু তার থেকে অন্তত তিনগুণ দামে বিক্রি করে৷ অথচ আমরা যে মূল্য দেই, আড়ং কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম টাকা দেয়৷ এছাড়া আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তারা সাত দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে যায়, তা আমার কাছে দেয়া ‘প্রোডাক্ট' বিক্রি হোক আর না হোক৷ আমি নিজে স্বেচ্ছাশ্রম দিই৷ শুধু অবহেলিত মানুষগুলোর উপকার করতে চাই আমি৷ নিজে জয়পুরহাটে গিয়ে দেখেছি, যারা কাজ করে তাদের সন্তানদের স্বাস্থ্য ভালো, তারা লেখাপড়া করছে৷ তাছাড়া এই কাজের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের উপার্জনও ভালো৷
আপনার মাধ্যমে কাজ করা নারীদের সংখ্যা কেমন হবে?
আমি যাদের মাধ্যমে কাজ করি, তাদের সংখ্যা দুই থেকে তিনশ'র বেশি হবে না৷ তবে একটা সমস্যা হলো, যারা এই কাজগুলো করে তাদের দালালরা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে৷ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে চলে যাচ্ছে নারীরা৷ বাইরে যাওয়ার জন্য এই নারীরা যেন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে৷ ফলে আমরা ভালো কিছু কর্মী ইতিমধ্যেই হারিয়ে ফেলেছি৷
আপনি শুরুতে বলছিলেন, এগুলোকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসা সম্ভব৷ তা সেটা কীভাবে সম্ভব?
অনেক মেয়ে এ ধরনের কাজ করে, কিন্তু তাদের ‘প্রোডাক্ট' বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না৷ তাছাড়া আমাদের মেয়েরা শুধু সেলাইয়ের কাজ করতে চায়৷ অন্য কাজে তারা খুব একটা আগ্রহ দেখায় না৷ যেমন ধরুন, যশোরে আমাদের মেয়েরা ভালো কাজ করে৷ আমি সরকারকে বলবো, তাদের জন্য কিছু জমি দেয়া হলে তারা স্বল্পমূল্যে বা কিস্তিতে সেখানে দোকান করে তাদের তৈরি প্রোডাক্টগুলো বিক্রি করতে পারত৷ এতে তাদের অনেক উপকারও হতো৷ কুষ্টিয়ার মেয়েরাও ভালো কাজ করে৷ কিন্তু তাদের পরিশ্রমের ফল দালালরা খেয়ে যাচ্ছে৷ তাই আমার পরামর্শ হলো, সেটা এলাকাভিত্তিক বা জেলা বা বিভাগীয় হতে পারে.... যারা এই ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাজ করে তাদের একটা জায়গার মধ্যে নিয়ে আসা৷ তাহলে তারা যেমন ন্যায্যমূল্য পাবে, তেমনি সরকারের একটা হিসাব থাকবে৷
অনেকেরই তো দোকান নেয়া বা কোনো ধরনের বিনিয়োগ করার সামর্থ্য নেই, তারা কী করবে?
জমি বা দোকান তো খুবই স্বল্পমূল্যে দিতে হবে৷ হ্যাঁ, অনেকের সেই টাকাও না থাকতে পারে৷ তাহলে তাকে বিশেষ ব্যবস্থায়, যেমন কিস্তিতে টাকা দেয়া যেতে পারে৷ আমি যখন মেলা করি, তখন অনেক মেয়ে আমার কাছে আসে৷ তারা বলে, জমি বা দোকান পেলে তারা উঠে দাঁড়াতে পারবে৷ তাই সরকারের উচিত তাদের সেই সুযোগ করে দেয়া৷
আপনি বলছিলেন বিপুল সংখ্যক নারী এই কাজের সঙ্গে জড়িত৷ তাঁদের এই কাজ আমাদের জিডিপিতে কতটা ভূমিকা রাখছে?
নিশ্চয়ই যোগ হচ্ছে৷ আমাদের এই নারীরা কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করছে৷ কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তারা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না৷ আড়ং বা মেলা'র মতো প্রতিষ্ঠান তাদের ঠিকমতো টাকা দিচ্ছে না৷ যারা কাজ করে তাদের যে চেক দিচ্ছে, সেটাও ‘বাউন্স' হচ্ছে৷ মেয়েরা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করার কারণে তাদের অবদানটা জিডিপিতে যোগ হচ্ছে, কিন্তু সবাই সেটা ঠিকমতো জানতে পারছে না৷ এটা যদি জেলা বা বিভাগীয় পর্যায় থেকে ‘মনিটরিং' করে পরিচালনা করা যেত, তাহলে পুরো জিনিসটা পরিষ্কার হতো এবং নারীরাও ঠকতো না৷ আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ইন্ডিয়ান ও পাকিস্তানি কাপড়ে বাজার ভরে গেছে৷ একই দামে মানুষ ইন্ডিয়ান বা পাকিস্তানি কাপড় কিনছে, কিন্তু দেশি কাপড় কিনছে না৷ ফলে এখানে যারা কাজ করছে তারাও অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ছে৷
এ বিষয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে, মন্তব্যের ঘরে৷