বিচারপতির আলোচিত রায়
৪ অক্টোবর ২০১৮মাত্র দু-সপ্তাহে বিদায়ী প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র ভারতকে সাবালক করে তুলেছেন৷ বলা যেতে পারে, নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিগত কয়েক দশকের বিতর্কের অবসান হয়েছে তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের রায়ে৷
সমকামীদের দাবি পূরণ হয়েছে৷ ভারতে সমকামকে বৈধতা দিয়েছেন তিনি৷ তাঁর রায়ে মুসলিম সম্প্রদায়ে দাম্পত্য সম্পর্কে ‘তিন তালাক’ বেআইনি ঘোষিত হয়েছে৷ শবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী নারী-সহ সব বয়সের নারীর প্রবেশকে অবাধ করেছেন তিনিই৷ জনস্বার্থ মামলায় তিনি রায় দিয়েছেন, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল সংযোগ নিতে আর বাধ্যতামূলক নয় ‘আধার’৷ দাম্পত্যে ব্যাভিচারের অভিযোগে লিঙ্গ বৈষম্য ঘুচিয়েছে তাঁরই নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ৷ নারীর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ ব্যক্তি পরিসর সুরক্ষিত থেকেছে৷ মান্ধাতা আমলের চিন্তাধারা ও আইন বদলেছে৷ সামাজিক বুনন আরো শক্তিশালী হয়েছে৷
তবে, এতগুলি রায়ের প্রশংসা যেমন হচ্ছে, তেমনি তাঁর কয়েকটি রায়ের সমালোচনাও শোনা যাচ্ছে৷ যেমন, মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁও হিংসা মামলায় ধৃত ৫ কবি এবং সমাজকর্মীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের নিরপেক্ষ ও উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ৷ এক মামলায় ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ'র বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল৷ সেই মামলার বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিসান লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর বিচার বিভাগীয় তদন্তের আর্জি খারিজ করেছেন৷ মসজিদে নামাজ বাধ্যতামূলক নয়, এই রায় দিয়েছেন ইত্যাদি৷
দীর্ঘদিন ধরে পুরুষের অধিকার নিয়ে সামাজিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কলকাতার মেয়ে নন্দিনী ভট্টাচার্য৷ ইদানিং একাধিক রায়ের পর বিচারব্যবস্থার ওপর আরো বেশি আস্থা রাখছেন তিনি৷ তাঁর আশা, দেশ যেদিকে এগোচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়ত মহিলা কমিশন, মানবাধিকার কমিশনের মতোই ‘পুরুষ কমিশন’ গঠিত হবে৷
ডয়ছে ভেলেকে নন্দিনী জানিয়েছেন, ‘‘দীপক মিশ্রের মধ্যে আমি ‘দাদাগিরি’ মনোভাব দেখেছি৷ এটা ওঁর নিজস্বতা৷ যার জন্য কখনো মনে হয়েছে উনি শাসক দলকে সাহায্য করে ফেলেছেন৷ আবার পরক্ষণেই মনে হয়েছে, উনি বিচারব্যবস্থার স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছেন৷ অবশ্যই এমন কিছু রায় দিয়েছেন, যেগুলো দেশকে খানিকটা সামনের দিকে এগিয়ে দিয়েছে৷ কিন্তু, আধারে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষিত হয়েছে, তেমন ভীমা কোরেগাঁও-কাণ্ডে তা রক্ষিত হয়নি৷ তা সত্ত্বেও অনেকগুলো বিষয়ে দেশবাসী ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে৷ উনি বিতর্কিত হয়েই থাকবেন৷’’
দীপক মিশ্রকে ঘিরে কম বিতর্ক হয়নি৷ শাসক বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বার বার৷ তাঁকে 'ইমপিচ’ করার জন্য বিরোধীরা প্রস্তাব এনেছিল সংসদে৷ ৮ মাস আগে বর্ষীয়ান চার ‘বিদ্রোহী' বিচারপতির নজিরবিহীন সাংবাদিক বৈঠকে তোপ দাগা হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার যোগসাজশের মতো মারাত্মক অভিযোগ তোলা হয়েছিল৷ এমনকি, প্রধান বিচারপতির এক্তিয়ারে থাকা সর্বোচ্চ আদালতের মামলা বন্টনে অনিয়মের অভিযোগও তোলা হয়েছিল৷ এতকিছুর পরেও বিচারপতি জে চেলামেশ্বর, বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি মদন বি লোকুর এবং বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফের সঙ্গে বার বার বৈঠক করে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করেছেন তিনি৷
উল্লেখ্য, বিচারপতি দীপক মিশ্র ১৯৬৬ সালের ১৭ জানুয়ারি ওড়িশা হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন৷ ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছিলেন৷ ইংরেজি সাহিত্যে পাণ্ডিত্যের অধিকারী দীপক মিশ্র কবিতা লিখতে ও পড়তে ভালোবাসেন৷
বহু মামলায় প্রধান বিচারপতির এজলাসে সওয়াল করার অভিজ্ঞা রয়েছে বাঙালি আইনজীবী অভিজিৎ সেনগুপ্তর৷ দীপক মিশ্রকে আর পাঁচজনের চেয়ে অনেকটা কাছ থেকে দেখেছেন তিনি৷
ডয়চে ভেলেকে অভিজিৎ জানালেন, ‘‘পৃথিবীর অন্য দেশে এই ধরনের পরিবর্তন হয়েছে৷ সেইসব দেশ তা সাদরে গ্রহণ করেছে৷ সেদিক থেকে ভারতকেও উনি (দীপক মিশ্র) অনেকটা এগিয়ে দিয়েছেন৷ পরকীয়া-রায়ে কোনো রাজনৈতিক সম্পর্ক খোঁজা উচিত নয়৷ আধার সংযুক্তির বিষয়টি প্রধান বিচারপতি সরকারের নজর দিয়ে দেখেননি৷ ওঁর রায় জনগণকে রেহাই দিয়েছে৷ বিরোধীদের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ এছাড়া আরো একটি দিক হলো, আইনজীবীদের সঙ্গে ওঁর সম্পর্ক৷ আইনজীবী ও জুনিয়রদের সঙ্গে নম্র, ভদ্র ব্যবহার ওঁর বিশেষত্ব৷ ওঁর দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে৷’’
অবসর নেওয়ার দিন দৃশ্যত যেন ভাবুক হয়ে উঠেছিলেন তিনি৷ আদালত কক্ষে এক আইনজীবী গেয়ে ওঠেন, ‘তুম জিও হাজারো সাল’৷ তখন প্রধান বিচারপতি অত্যন্ত শান্ত স্বরে তাঁকে থামিয়ে বলেছেন, ‘‘এখন আমি নিজের হৃদয় থেকে বলছি৷ মস্তিস্ক থেকে বলব সন্ধ্যায়৷’’ সেদিন সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানো হয় তাঁকে৷ বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নতুন প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন৷