1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিচার ব্যবস্থার প্রতি কি মানুষের আস্থা কমছে?

২৩ এপ্রিল ২০২২

সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহতের স্বজনরা বলছেন, আমরা ‘বিচার চাই না'৷ কেন তারা বিচার চান না? বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা, নাকি বিচারের খরচ জোগাতে না পারা? নাকি অন্য কিছু?

https://p.dw.com/p/4AKpB
নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুর আমতলা রেলগেট এলাকায় বান্ধবীর সঙ্গে রিকশায় থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি৷ আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে মারতে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে সেই গুলি গিয়ে লাগে প্রীতির শরীরেও৷ মেয়ের এমন মৃত্যুর পর তার বাবা জামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না৷ আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম৷ কার শাস্তি চাইব? বিচার নাই, বিচার কার কাছে চাইব?''

শনিবার ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে একই কথা বললেন জামাল উদ্দিন৷ কেন বিচার চান না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিচার হলে কি আমার মেয়ে ফিরে আসবে? আসবে না৷ আমি খুব ছোট একটা চাকরি করি৷ অনেক কষ্ট করে চলি৷ এখন বিচার চাইতে গেলে যে খরচ হবে সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই৷ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা যে একেবারে নেই তা নয়? কিন্তু বিচার হতে হতে তো অনেক বছর লেগে যাবে, এতদিন আদালতে দৌড়ানোর মতো অবস্থা আমার নেই৷ ফলে আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রেখেছি৷''

একইভাবে নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হাসান৷ ছেলের মৃত্যুর পর মো. নাদিম বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না৷ বিচার চেয়ে কী লাভ? কার কাছে বিচার চাইব?৷''

মো. নাদিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি গরীব মানুষ৷ আমি বিচার চাই না৷'' আপনার পক্ষে তো আপনার ভাই মো. শরীফ বাদি হয়ে মামলা করেছেন? আপনি কি এই মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না? জবাবে জনাব নাদিম বলেন, ‘‘না, আমি এই মামলার বিষয়ে কিছু জানি না৷ কেউ আমার অনুমতি নেয়নি৷ পুলিশ আমাকে মামলা করতে বলেছিল, আমি রাজি হইনি৷ আমার এমনিতেই সংসার চলে না, বিচার চেয়ে কি হবে?''

সাম্প্রতিক সময়ের শুধু এই দু'টি ঘটনাই নয়, এর আগেও অনেকেই বলেছেন বিচার চান না৷ এর আগে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনের হত্যাকাণ্ডের পর তার বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকও বলেছিলেন, ‘তিনি বিচার চান না৷' এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনাও হয়েছিল৷ সবশেষ তিনি একই অবস্থানে ছিলেন৷

‘বিচার হলে কি আমার মেয়ে ফিরে আসবে?’

সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নেহাল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের বিচার ব্যবস্থার উপর তাদের আস্থা নেই বলেই তারা বিচার চান না৷ এখানে বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে, বিচারের নামে প্রহসন আছে, সেজন্য তারা বিচার চায় না৷ আমাদের নীতিনির্ধারকেরা অনেক বড় বড় বুলি দেন, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এর কোন মিল নেই৷ আমরা উন্নয়নের রোল মডেল বলছি, শহরে ফ্লাইওয়ার হলে গ্রামের মানুষের কোন উপকার হয়? ২ হাজার কোটি টাকা স্যাটেলাইট করলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কি উপকার হয়? আসলে আমাদের রাষ্ট্রটা পুজিবাদী রাষ্ট্র, সে হিসেবেই তারা চলছে৷ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কথা তারা ভাবে না৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি অনেকদিন ধরেই বলে আসছি আমাদের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম যেটা সেটা দিয়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবো না৷ পুলিশ, কোর্ট, প্রিজন ও প্রসিকিউশন এই চারটা জিনিস নিয়েই তো ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম৷ এর মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও তাদের মধ্যে একটু হলে পরিবর্তন এসেছে৷ কিন্তু কোর্ট, প্রিজন এবং প্রসিকিউশন একেবারেই সেকেলে রয়ে গেছে৷ আসলে কলোনিয়াল সেট আপ থেকে তারা এখনও বের হতে পারেনি৷ ব্রিটিশরা এগুলো তৈরি করেছিল তো মানুষকে শোষণ ও শায়েস্তা করার জন্য৷ এখন স্বাধীন দেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তন দরকার৷ এই ধরনের বক্তব্য আমাদের উদ্বিগ্ন করে৷ এগুলো কিন্তু কোন আর্টিফিয়াল বক্তব্য না৷ একেবারেই সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ এই ধরনের কথা বলছেন৷ ফলে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এগুলো নিয়ে ভাবতে হবে৷''

‘বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে, বিচারের নামে প্রহসন আছে’

তবে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা উঠে গেছে বিষয়টি এমন করে ভাবতে রাজি নন ড. শাহদীন মালিক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘গত বছর বাদে আগের ১০ বছর ধরলে প্রতি বছর সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে৷ ১০ বছরে তাহলে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হত্যাকাণ্ডের মধ্যে এই ধরনের কথা বলেছেন কতজন? তিনজন বা চারজন৷ যদিও একজনও এমন কথা বলুক সেটা আমরা চাই না৷ তারপরও এই সংখ্যাটা খুবই কম৷ মাস তিনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক ৪০টা মামলা ঘেঁটে দেখেছেন বিচারিক আদালতে একটা মামলা শেষ হতে গড়ে সাড়ে ৪ বছর লেগেছে৷ আর উচ্চ আদালতে লাগে আরও সাড়ে ৫ বছর৷ সবমিলিয়ে একটা মামলার নিষ্পত্তি হতে ১০ বছর লাগলেও সারা বিশ্বের হিসেবে এটা বেশি সময় না৷ উন্নত দেশগুলোতেও এর কাছাকাছি সময় লাগে৷ আবার দেখেন আদালতে সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের৷ সাক্ষী না আসলে বিচারক তো তাকে হাজির করতে পারেন না৷ এটা পুলিশকেই করতে হয়৷ ফলে বিচারক দিনের পর দিন পেছাতে বাধ্য হন৷ সবাই তো বলেন, মামলা বিলম্বিত হয়, কিন্তু কেন হয় সেটা তো আর কেউ দেখে না৷ পুলিশ সাক্ষী হাজির করে না বলেই মূলত বিলম্ব হয়৷''

বিচার ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থা নেই কেন? জবাবে জনাব মালিক বলেন, ‘‘নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পুরোপুরি আলাদা না হওয়ার কারণে এটা হচ্ছে৷ এটা করা হচ্ছে না কারণ কিছুটা হলেও যেন নির্বাহী বিভাগের প্রভাব বিচার বিভাগের উপর থাকে৷ জনগণ হয়ত বুঝতে পারছে, যে কারণে আস্থা বাড়ছে না৷''

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷